মো. আশরাফুল আলম:“লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে” কথাটা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। কথাটা সত্যও ছিলো। কিন্তু কালের বিবর্তনে তা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন বলা হচ্ছে- পড়ালেখা করে যে হয়রানিতে ভোগে সে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা যেন এখন বেকারত্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা আমাদের উচ্চশিক্ষিতদের জন্য অশনিসংকেত।
সম্প্রতি দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি। দেশের অর্থনীতি বাড়ছে, ক্ষুধা দূর হয়েছে, দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা কমছে, কমছে শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার, শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটছে, মানবসম্পদ উন্নয়নের সূচকগুলোও ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু উল্টো হচ্ছে উচ্চশিক্ষিত যুবসমাজের চাকরি-বাকরির বেলায়। এ দেশে বেকারত্বের হার তাদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি, যারা সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত। তাদের বেকারত্ব আরও বেড়ে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। দেশে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীর সংখ্যা এখন প্রায় ৫ কোটি। প্রতিবছর এ সংখ্যা বাড়ছে গড়ে প্রায় ৪.৫ লাখ করে যা বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশে শ্রমশক্তি জরিপে সপ্তাহে এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজের সুযোগ না পাওয়া কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়। আইএলও এর প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২০১০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে মাত্র ৭ বছরে। ২০১৩ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের বেকারত্বের হার ছিল ৪.৪%। কিন্তু ২০১৭ সালে তা ১২.৮%। শুধু তাই নয়, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব ১০.৭% যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮ টি দেশের মধ্যে ২য় সর্বোচ্চ; প্রথমে রয়েছে পাকিস্তান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার যা আগের বছরের চেয়ে ৮৭ হাজার বেশি। আইএলওর তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেকারত্বের হার ছিল ২০১০ সালে। এরপর থেকে তা কেবল বাড়ছেই। ওই বছর মোট শ্রমশক্তির ৩.৪% বেকার ছিল, যা ২০১৬ সালে ৪.৪% এ দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে দেশে ২০ লাখ লোক বেকার ছিল। ২০১২ তে ২৪ লাখ, ২০১৬ তে ২৮ লাখে উঠেছে এবং ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৩০ লাখে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।
শ্রেণিকক্ষ সঙ্কট, আবাসন সঙ্কট, শিক্ষক সঙ্কট, সেমিনার ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব, গবেষণাগার ও কম্পিউটার ল্যাব না থাকা, সেশনজট, যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে চাকরির বাজারে সার্টিফিকেটের জোরে আর টিকে থাকতে পারছে না আমাদের উচ্চশিক্ষিতরা। ফলে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা রয়ে গেছে যুগের অনেক পিছনে। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, কৃষি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর একাডেমিক পড়া শেষ করে মুখস্থ করতে হয় রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কতটা কাব্য রচনা করেছেন, বঙ্কিম চন্দ্রের জন্ম কত সালে ইত্যাদি। তাহলে চরম নীতি বিরোধী শিক্ষা ব্যবস্থা কী করে বেকারত্বের হার কমাবে? এদিকে একাডেমিক পড়ায় সময় বেশি দিলে চাকরির প্রস্তুতি হয় না। আবার চাকরির প্রস্তুতি নিলে একাডেমিক পড়া হয় না। এ যেন উভয় সঙ্কট। একাডেমিক রেজাল্ট ভালো করে চাকরি পাওয়া যায় না কারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে মিল রেখে কর্মসংস্থান নেই বা করা হয়নি। চাকরির বাজারের পড়া বাংলা, ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞান দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আবার বাংলা, ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞান পড়ে চাকরি করতে হচ্ছে। ৫ বছর একাডেমিক পড়া শেষ করে আবার চাকরির পড়া পড়তে গিয়ে বয়স শেষ।
চাকরির বাজারে আবার কোটার জাল পাতানো। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ কোটার দখলে। অন্য দিকে বিসিএস-এ ৫৫ শতাংশ নিয়োগ দেয়া হয় কোটা থেকে। তাহলে ১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে ৫৬ শতাংশ, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে ৭০ শতাংশ এবং বিসিএস থেকে ৫৫ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত মেধাবী বেকার হচ্ছে কোটার কারণে। যদিও ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে ১ম ও ২য় শ্রেণির চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা থাকবে না বলে প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়েছে।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি, নারী, পোষ্য, জেলা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (উপজাতি), খেলোয়াড় ও প্রতিবন্ধীসহ ২৫৭ ধরনের কোটা। আবার মামা-খালু, চাচা না থাকায় অনেক মেধাবী ভাইভা বোর্ড থেকে অদৃশ্য বেকারত্বের সার্টিফিকেটধারী হয়ে বের হচ্ছে। গরীব মেধাবী উচ্চশিক্ষিতরা টাকার অভাবে চাকরির বাজার থেকে সহজেই বিদায় নিচ্ছে। দুর্নীতির অবস্থা এমন হয়েছে যে, এটা যেন নিয়ম হয়ে গেছে। টাকা ছাড়া বা লোক ছাড়া চাকরি হবে না। তাই যদি হয় তাহলে পড়ে আর লাভ কী? তাই এসএসসি বা এইচএসসি পাস দিয়ে টাকায় মিলছে চাকরি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে মিলছে বেকারত্ব উপাধি।
বর্তমান সময়ে বেকারত্ব সমস্যাটি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব খাতকে চাঙ্গা করছে। চাকরি দেয়ার নামে বিজ্ঞাপণ প্রদান করে বেকার যুব সমাজের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। প্রতিটি আবেদনের জন্য ব্যাংক ড্রাফট কিংবা পে-অর্ডার কিংবা টেলিটক মোবাইলের মাধ্যমে ৫০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত পরীক্ষার ফি নেয়া হচ্ছে। অথচ বিষয়টা উল্টো হওয়ার কথা ছিল।
সম্প্রতি খাদ্য অধিদপ্তরের সহকারী খাদ্য পরিদর্শকের এক পদের বিপরীতে আবেদন করেছে প্রায় ১২০০ চাকরি প্রত্যাশী। বিষয়টি আমাদের সমাজের জন্য কি ধরনের প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো মাথা ব্যথা নেই। অথচ অনেক দায়িত্বশীল পদে থাকা ব্যক্তিবর্গ বলে উঠেন দেশে নাকি বেকার সমস্যা নেই। সম্প্রতি ৪০তম বিসিএস এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আবেদন জমার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সেখানেও প্রায় ৪ লক্ষ চাকরি প্রত্যাশী আবেদন করেছে। টাকার অংকে হিসেব করলে তা দেশের রাজস্বকে সমৃদ্ধ করছে। অথচ পুরো টাকাটাই আসছে বেকারের পকেট থেকে। অন্যদিকে সকল পরীক্ষার কেন্দ্র ঢাকায় হওয়া চাকরি প্রত্যাশীদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া মিলিয়ে আরও প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতাও বেকার যুবকদের হাহাকারের অন্যতম বড় একটি কারণ।
যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের রয়েছে পর্যাপ্ত অভাব। রয়েছে দেশের অসুস্থ্য রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। সবকিছু মিলিয়ে দেশের ভেতরে চলছে চরম হতাশা। যোগ্যতা সম্পন্ন এমন উচ্চশিক্ষিতরা পেটের দায়ে জড়িয়ে পড়ছে ছিনতাই-চাঁদাবাজির মত বিভিন্ন খারাপ কাজে, মাদকের পেছনে, অসুস্থ্য রাজনীতির পেছনে। একটি দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিকের বর্তমান অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান হওয়া ছাড়া নিয়ে কোনো উপায় নেই। আর তাই বেকার সমস্যা দূর করতে হলে বেকার হওয়ার প্রধান কারণগুলো দূর করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে করতে হবে যুগোপযোগী ও মানসম্পন্ন। শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে। অসুস্থ্য রাজনীতির ছোঁয়া থেকে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাইরে রাখতে হবে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা বিধান করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারকে কর্মে আন্তরিক হতে হবে।
বেসরকারিভাবে কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ ও যথাযথ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের বিধান করে দিতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান সুনামের সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছে। সরকারি চাকরির সুবিধার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করলেও অনেক বেকার যুবকের বেকারত্ব দূর হয়ে যাবে। সরকারের সদিচ্ছাই পারে বর্তমানে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতির সমাধান দিতে। মনে রাখতে হবে বেকারত্বের গতি রোধ করা না গেলে দেশের উন্নয়ন থেমে যেতে বাধ্য হবে। কেননা বেকারত্ব কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নয় এটা জাতীয় সমস্যা।
**********************
মো. আশরাফুল আলম. অতিথি লেখক