কাজী কামাল হোসেন,নাটোরের নলডাঙ্গা থেকে ফিরে:বন্যার পানি এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা বাংলাদেশের জন্য এখন কোন অভিশাপ নয় বরং আর্শিবাদ। বন্যা এবং অতিবৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করে বিশেষ পদ্ধতিতে ভূপৃষ্টের অতিরিক্ত পানি ভূ-অভ্যন্তরে সংরক্ষন করেন। পরবর্তীতে সেই পানি খরা মৌসূমে সেচ কাজে ব্যবহার করে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে লাভবান হয়ে প্রমান করেছেন নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার দিয়ার কাজীপুর গ্রামের কৃষকরা।
নর্থ-বেঙ্গল রিসার্চ ফাউন্ডেশন এ্যন্ড ডেভলপমেন্ট’ (এনআরডি)-এর (চেয়ারম্যান) গবেষক মো: মহিদুল ইসলাম পরিক্ষামূলক ভাবে ২০১৫ সালে এখানে ভূ-গর্ভাশায়ণ স্থাপনের জন্য বিভিন্ন প্রকার জরিপ ও পরীক্ষা নিরিক্ষা শেষে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সফল বাস্তবায়ন করেন, যার নাম দিয়েছেন ভূ-গর্ভাশায়ণ। এ ক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগীতা করেন ইন্ডিয়ার নারিতা সার্ভিস লি:।
বাংলাদেশে প্রথম ভূ-গর্ভাশায়ণ নামক এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে খরা প্রবণ এলাকায় বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে জমা রেখে শুষ্ক মৌসুমে এ পানি নিবিঘ্নে ব্যবহার করা যাবে এবং জলাবদ্ধ এলাকার অতিরিক্ত পানি ভূগর্ভে রিচার্জ করে জলাবদ্ধ এলাকার জমিকে চাষাবাদ উপযোগী করা যাবে। পাশাপাশি লবনাক্ত এলাকায় বর্ষা মৌসুমে পানি ভূগর্ভে রিচার্জ করে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ এমনকি সুপেয় পানি হিসেবেও পান করা যাবে। প্রতিটি ভূ-গর্ভাশায়ণ বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৩০/৩৫ বিঘা জমির হাটু পরিমান পানি শোষন এবং খরা মৌসুমে সমপরিমান কৃষি জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব । এতে খরচ পড়বে প্রায় ৭লক্ষ টাকা এবং আয়ুষ্কাল হবে প্রায় ৩০/৩৫ বছর। এটি জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারনে সৃষ্ট পানির অভাব দুর করার জন্য লাগসই প্রযুক্তি এবং এটি বাংলাদেশে ব্যবহার উপযোগী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুবিধাভোগী দিয়ার কাজীপুর গ্রামের কৃষকরা জানান, বর্ষাকালে এই বিলে জমা হওয়া পানি অন্য কোনদিক দিয়ে বের হতে পারতো না, তাই জলাবদ্ধতার কারণে আমরা এখানে কোন ফসল উৎপাদন করতে পারতামনা। এই বিলে ভূ-গর্ভাশায়ণ স্থাপনের ফলে আমাদের জলাবদ্ধতা দুর হয়েছে। এখন আমরা বর্ষা এবং খরা দুই সময়েই ধান, গম, আখ, তিল,ডাল, ভূট্টাসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপাদন করতে পারছি। তারা বলেন, এই বিলে বর্ষার সময় যখন পানি বেশী হয়, তখন আমরা ভূ-গর্ভাশায়ণের নিয়ন্ত্রিত সব গুলো মুখ খুলে দেই। এইসব মুখ দিয়ে যে পরিমান বিলের পানি অপসারণ করা প্রয়োজন- ঠিক সেই পরিমান অতিরিক্ত পানি ফিল্টার হয়ে মাটির নিচে চলে যায়। এখন আমরা আবাদ ফসল সহজেই জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। আবার খরার সময় যখন পানির দরকার হয় তখন আমরা ওখান থেকে মেশিন দিয়ে পানি তুলে ফসলে সেচ দেই, এই জন্য ভালো ফসল হয়। এখন আমাদের এই বিলে খরাও নাই বর্ষাও নাই।
স্থানীয় সেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন ‘আমরা’ এর সভাপতি আজাদুর রহমান বলেন, বর্ষার সময় দীর্ঘদিন এখানে পানি জমে থাকার ফলে এখানকার পানি এতোটাই দুষিত হতো যে এই পানিতে নামা যেতোনা। নামলেই হাত-পা চুলকায়। হয়তো এজন্যই এর নাম হয়েছে চুলকানীর বিল। তিনি আরো বলেন, চার কোনাকৃতির ভূ-গর্ভাশায়ণটি দেখতে অনেকটা বক্সের মতো। এর চতুর্দিকে ৮ টি পানি প্রবেশের মুখ আছে, যা দিয়ে এর মধ্যে পানি প্রবেশ করে এবং ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে একটি পাইপ দিয়ে পানি মাটির নিচে প্রবেশ করে । আবার শুষ্ক মৌসুমে একই পাইপ দিয়ে পাম্পের সাহায়্যে জমানো পানি উত্তোলন করা হয়। এই সুফল পেয়ে স্থানীয় কৃষকরা এর নাম দিয়েছে যাদুর বাক্স।
মহিদুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে মার্স্টাস এবং আইইআর থেকে এমফিল ফেলো হিসেবে রির্সাস কোর্স ওর্য়াক সম্পন্ন করে তিনি আইআরসি-ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার এন্ড স্যানিটেশন সেন্টার, নেদারল্যান্ড-এর সাউথ এশিয়ান ইয়াং প্রফেসনাল হিসেবে বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি খরা, বন্যা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্তা সমাধানের জন্য টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়ন, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীবন জীবিকার মান উন্নয়ন, পুনর্বাসন, পরিবেশ সম্পর্কিত বিশ্লেষণ ও জেন্ডার সমতা নিরুপনে কাজ করছেন। তিনি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন-
ভূ-গর্ভাশায়ণ কি?
ভূ-উপরিভাগের পানি ভূগর্ভের শুন্য স্তরে ধারণ করার প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত বন্যা বা জলাবদ্ধতা’র পানি বিশেষ পদ্ধতিতে ধরে ভূ-অভ্যন্তরে শূন্য স্তরে (প্রাকৃতিক) রাখা হয়। পরবর্তীতে সেই পানি শুষ্ক মৌসুমে উত্তোলন করে সেচ বা প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করাই মাধ্যমই হল ভূ-গর্ভাশায়ন পদ্ধতি। প্রযুক্তিটা খুবই সাধারণ; গভীর নলকূপের মতো একটি পাইপ ভূ-গর্ভের শুন্য স্তর পর্যন্ত নেয়া হয়। বর্ষা মৌসুমের বন্যা কিংবা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে গ্রাভিটেশনাল ফোর্সের মাধ্যমে পানির স্তরের শুন্য স্থানে সংরক্ষন করা হয়। পরবর্তীতে শুষ্ক মৌসুমে সংরক্ষিত পানি তুলে চাষাবাদ সহ খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশে ভূ-গর্ভাশায়ণের প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
বাংলাদেশ কৃষির উপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল। তাই দেশের বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা যোগান দিতে ভূমির সর্বত্তম ব্যবহার খুবই জুরুরী। কিন্তু অত্যন্ত উদ্ববেগের বিষয় হলো বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাবের কারণে শস্য উৎপাদন ব্যপক ভাবে ব্যহত হচ্ছে। ইতিমেেধ্য আমরা জলবায়ুর প্রভাব নানা ভাবে অনুভব করছি, যেমন- শুষ্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টি এবং খরা, বর্ষার সময় অতি বৃষ্টি, নানা ধনণের বন্যা (হঠাৎ বন্যা), জলাবদ্ধতা, জলো”্ছাস, ঝড়, উপকূলীয় অঞ্চলে লবনাক্তাসহ নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থা এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। ফলে কৃষক ও শ্রমজীবি মানুষের আর্থ-সামাজিক, খাদ্য নিরাপত্তা তথা সার্বিক জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে চরম দুর্ভোগের স্বীকার হচ্ছে এবং সমাজে জেন্ডার অসমতা দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ সব প্রভাব মোকাবেলা করে খাদ্যশষ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে এবং মানুষের জীবন জীবিকা নির্বিগ্ন করতে ভূ-গর্ভাশায়ন বাংলাদেশের জন্য খুবই যুগোপযোগী।
ভূ-গর্ভাশায়ণ প্রযুক্তির কার্যকারিতা কিকি?
১.অতি বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট হঠাৎ বন্যা বা স্থায়ী বন্যার হাত থেকে কৃষি ফসলকে রক্ষা করা।
২.জলাবদ্ধতা দুর করে জমিকে চাষাবাদের উপযোগি করা।
৩.খরা কবলিত বরেন্দ্র অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে প্রাপ্ত পানিকে ধরে রেখে সেই পানি শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজে ব্যবহার করে চাষাবাদ বৃদ্ধি করা।
৪.উপকুলীয় অঞ্চল যেখানে লবনাক্ত পানির জন্য শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ করা যায় না, সেখানে চাষাবাদ করা এবং সুপেয় পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভাশায়ণ প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করবে?
বরেন্দ্র অঞ্চলে সাাধরণত (রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ) প্রধান খাদ্য শস্য হিসেবে আমন ও বোরো উভয় মেীসুমে ধান উৎপাদন করে। কিন্তু শুষ্ক মেীসুম বা বোরো মৌসুমে চাষাবাদে যে পরিমান পানি লাগে তা সাধারনত: স্যালো(অগভীর নলকুপ) এর মাধ্যমে পাওয়া যায় না। তাই প্রায়শঃই পর্যাপ্ত পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হয় এবং কাংক্ষিত ফলন পাওয়া যায় না। এমনও হয় যে, ভূগর্ভস্থ পানি তোলার জন্য মাটি খুড়ে স্যালো মেশিন প্রায় গড়ে ২০-৩০ ফিট পর্যন্ত নিচে নামিয়ে নিয়ে পানি তুলতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তারপরও পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। ফলে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয়, যদি বৃষ্টির পানি না হয় তাহলে ফসল মারা যায়। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো, গত প্রায় ৩৫ বছর ধরে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভের পানি উত্তোলনের ফলে ভূ-অভ্যন্তরে পানিরস্তর ব্যাপক ভাবে নিচে নেমে গেছে, যার দরুণ রাজশাহী ও নওগাঁ জেলার কোন কোন স্থানে গভীর নলকূপও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এছাড়াও যখন গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভের পানি উত্তলোন করতে থাকে তখন বসত-বাড়ীতে যে সব নলকূপ রয়েছে, সেগুলোতে আর পানি পাওয়া যায় না। তাই আমি মনে করি, এই ভূ-গর্ভাশায়ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির সমস্যা শতভাগ পূরণ করা সম্ভব।
বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ভূ-গর্ভাশায়ণ কি কাজ করবে?
জলাবদ্ধতা এমন আকার ধারন করেছে যে, জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। জলবদ্ধতার জন্য আমন চাষ রহিত হয়ে গেছে। শুধু মাত্র শীতকালীন বোরো চাষ একমাত্র প্রধান খাদ্য শষ্য হিসেবে উৎপাদিত হচ্ছে। এর পরও অসময়ে সৃষ্ট ঝড়-বৃষ্টি এই ফসল ঘরে তোলাও অনিশ্চিৎ করে তোলে। তাই ভূ-গর্ভাশায়ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে জলাবদ্ধতাকে জয় করে আমন মৌসুমে ধান উৎপাদন করতে পারলে উক্ত এলাকা আবারও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন হতে পারবে। হাওড় অঞ্চলের সমস্যা এই প্রযুক্তি কার্যকরি ভূমিকা রাখবে।
লবনাক্তায় ভূ-গর্ভাশায়ণ কতটা কার্যকর?
দক্ষিন উপকূলীয় অঞ্চল লবনাক্তায় দুষ্ট। এ অঞ্চলের ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-উপরিভাগ উভয় পানিই অতিরিক্ত লবনাক্ততায় দুষ্ট। এর ফলে সুপেয় পানীয় জলের যেমন অপ্রতুলতা বিদ্যমান তেমনি কৃষিতেও রয়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ২-৩ টি ফসল উৎপন্ন হলেও উপকুলীয় অঞ্চলে শুধু মাত্র বর্ষা মৌসুমে আমন ধান উৎপন্ন হয়। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব এঅবস্থাকে আরো প্রকট করে তুলেছে। তাই ভূ-গর্ভাশায়ণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবনাক্তা দূর করা সম্ভব।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, এক দিকে ঢাকা শহরে এখন মাটির নিচে পানি পাওয়া যায়না ফলে সুপেয় পানির প্রায় ৮০ ভাগ ঢাকার বাহির থেকে নিয়ে আসতে হয়, অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে পানি বের হতে না পেরে চলাচলের রাস্তায় হাঁটু কিংবা কোমড় পরিমান পানি জমে। এক্ষেত্রে ভূ-গর্ভাশায়ণ পদ্ধতিটি সময় উপযোগী। প্রয়োজনের তাগিদেই আমরা এই পদ্ধতি ঢাকা শহরে প্রয়োগের চেষ্টা করছি। আমি মনে করি এটি ঢাকাসহ রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগে প্রয়োগের মাধ্যমে খড়া এবং বর্ষার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মতিন আহমেদ বলেন, চাষাবাদসহ বিভিন্ন কারনে আমরা যে পরিমান পানি ভূ-অভ্যন্তর থেকে উত্তোলন করছি ঠিক সে পরিমান পানি ভূগর্ভে রিচার্জ না হওয়ায় ক্রমশ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। আবার বর্ষার অতিরিক্ত পানিতে আমরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। যার ফলে আমাদের এই আর্টিফিসিয়াল রিচার্জ জরুরী প্রয়োজন। ভূ-গর্ভাশায়ন প্রকল্পটি জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে কৃষিতে পড়া নেতিবাচক প্রভাব দূর করে চাষাবাদ করে অধিক ফসল উৎপাদনে অবদান রাখবে। এটা জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারনে সৃষ্ট পানির অভাব দুর করার জন্য একটি লাগসই প্রযুক্তি। ভূ-গর্ভাশায়ণ প্রযুক্তিটি বাংলাদেশে ব্যবহার উপযোগি।