আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি:কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে কৃষি বিষয়ক তথ্য প্রবাহকে গতিশীল করতে না পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে না। তাই ই-কৃষি এখন সময়ের চাহিদা। কৃষি একটি গতিশীল বিজ্ঞান। গবেষণার মাধ্যমে প্রতি নিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রযুক্তি সময়মতো কৃষকের কাছে না পৌঁছালে এর সুফল পাওয়া যাবে না।
আমাদের দেশে একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে আবাদী জমির পরিমান কমছে। এ অবস্থায় কম জমিতে বেশি খাদ্য উৎপাদন করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে প্রচলিত ধারায় নতুন উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তি কৃষকের কাছে পৌঁছাতে বেশ সময় লাগে। অনেক সময় এসব আর উপযোগী থাকে না। ফলে নতুন উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তির সুফল মাঠে প্রতিফলিত হয় না। আর এসকল বিষয় বিবেচনা করে ই-কৃষি ব্যবহার অত্যান্ত জরুরী।
এগ্রিলাইফ টুয়েন্টিফোরের সাথে সাথে আলাপকালে কৃষি সম্প্রসারণের নানা বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেবাশিস সরকার দেব। তিনি বলেন কৃষির সম্প্রসারণ সঠিকভাবে হলে, কৃষিজাত পণ্য রপ্তানীতে বিশ্বে এক নম্বর দেশ হবে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের জন্য কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। এটাই ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে যেমন কৃষির উন্নয়ন হচ্ছে, তেমনি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জমির উৎপাদনশীলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষির ও আমূল পরিবর্তন হয়েছে এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আজ আমরা দানাজাতীয় খাদ্য শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। তদপুরি ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও জলবায়ূ পরিবর্তন জনিত কারনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করনে ভাল বীজের সরবরাহ নিশ্চিতকরণের কোন বিকল্প নেই।
খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অজর্নে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। আর ফলন বৃদ্ধির জন্য ভাল বীজের গুরুত্ব অপরিসীম। বীজ ভাল না হলে অন্যান্য কৃষি প্রযুক্তি যতই ব্যবহার করা হোক না কেন তা ভাল ফলন বয়ে আনবে না। ভাল বীজ নিশ্চিত করা গেলে ১৫-২০% ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের কৃষকদের মাঝে ভাল বীজ এর গুরুত্ব ও ভাল বীজ উৎপাদন সংক্রান্ত জ্ঞান অত্যন্ত অপ্রতুল। তাই চাষীদের মাঝে উন্নতমানের বীজ ব্যবহারের সচেতনতার বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই।
এই শিক্ষক বলেন, দেশে কৃষি সম্প্রসারণ যতটা হওয়া উচিত বাস্তবে তা হচ্ছে না। বাজার উপযোগী ও চাহিদা অনুরূপ প্রযুক্তি উদ্ভাবন না করায় সম্প্রসারণও সেভাবে করা যাচ্ছে না। কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, একইসাথে বাজারে তার চাহিদা কতটুকু সেটা বিবেচনা করে গবেষণা ও কৃষি প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে হবে। আবার আবিষ্কৃত হলেও সেটির প্রচার হচ্ছে তেমন হচ্ছে না। টেলিভিশন এক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখেতে পারে। তবে কৃষি সম্প্রসারণের খবরগুলো প্রচার হচ্ছে খুবই কম। পিক টাইম (যে সময় দর্শক বেশি থাকে) সে সময়গুলোতে কৃষির তথ্যগুলো প্রচার করার বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করতে হবে। এটি করতে পারলে বেশি লোকের কাছে তথ্যগুলো পৌঁছানো সম্ভব।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত গবেষণা ও প্রযুক্তিগুলো মাঠ পৌঁছাতে সময় লাগছে এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাকৃবিতে গবেষণা কর্মশালায় কৃৃষি কর্মকতা ও সম্প্রসারণ কর্মকতাদের যুক্ত না করার কারণে এটা হচ্ছে। কারণ মাঠ পর্যায়ে তাঁদের মাধ্যমেই গবেষণাটি কৃষকের কাছে যায়। তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারলে সমস্যাটি কেটে যাবে। এছাড়াও সেগুলো মাঠ পর্যায়ে নিতে যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সত্যিকার অর্থেই তারা সেটি মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটিও নজরদারিতে রাখতে হবে।
বাকৃবির কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগ কৃষি গ্রাজুয়েট তৈরিতে কিভাবে সহায়তা করছে এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কৃষি সম্প্রসারণের শিক্ষা দেওয়া হয়। বিভাগের দক্ষ শিক্ষকরা স্নাতক স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক বিষয়ে শিক্ষা দেন। তত্ত্বীয় জ্ঞানের পাশাপাশি ৭ দিনের মাঠ সফরেও শিক্ষার্থীদের উপজেলার গ্রামীন কৃষকের কাছাকাছি নেওয়া হয়। যাতে তারা হাতে কলমে সেটি শিখতে পারে। এছাড়া কৃষির সকল সেক্টরের কর্মকতাগণও সেসময় তাদের পাঠদান করে থাকেন। যারা এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণের জ্ঞানে তাদের দক্ষতার কোন কমতি নেই বলে আমার মনে হয়।
কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করলে কৃষি সম্প্রসারণ আরো অধিকভাবে করা যেতে পারে, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গ্রামের কৃষকদের নিয়ে দল সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মধ্যে একতা ও সমবায় করতে হবে। আমাদের দেশে প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষক বেশি হওয়ায়, কৃষি বিষয়ক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বৃহৎ বাজার সৃষ্টিতে দলগত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরী। তাছাড়া মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও বীজ সংরক্ষণ কার্যক্রমে নারী শ্রমিকের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে নারী শ্রমের উপযোগীতার ব্যবহার সম্ভব। এর ফলে যেমন নারী ক্ষমতায়ন বেগবান হবে অন্যদিকে পল্লী অঞ্চলের দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখবে।
কৃষির সম্প্রসারণ সঠিকভাবে হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কৃষি কোন পর্যায়ে যাবে এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন করে কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এমনকি পুষ্টি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। কৃষক পর্যায়ে বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে বীজ চাহিদা যেমন মেটানো যাবে, তেমনি দেশের কৃষির সার্বিক উন্নয়ন তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। এক কথায় বললে আমরা কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানীতে বিশ্বে এক নাম্বার দেশ হতে পারবো।