কৃষিপণ্য রপ্তানি একটি সম্ভাবনাময় খাত ও কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ

ড. জগৎ চাঁদ মালাকার:বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে দানাদার খাদ্যশস্যের পাশাপাশি শাক সবজি ও ফলমূল উৎপাদনে দেশে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে ধান ও শাকসবজির উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনে দশম স্থান অধিকার করে কৃষি উন্নয়নের উজ্জল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত কৃষিজপণ্য রপ্তানীর এক বিশাল সম্ভবনা থাকলেও সেই সুযোগ আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না।

বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র এবং International Plant Protection Convention (IPPC) এ স্বাক্ষরকারী দেশ। তাই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যা নিরাপত্তার জন্য দেশের কৃষিকে রক্ষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে WTO-SPS Agreement এবং International Plant Protection Convention (IPPC) এর বিধি বিধান অনুসরণ করা সকল দেশের জন্য বাধ্যতামূলক।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমুহে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে Non Compliance-এর মাত্রা কমানোর লক্ষ্যে Eropean Union (EU) চাহিদার ভিত্তিতে ২০১৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকার অদূরে হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর ঢাকা থেকে ২৭ কি.মি. দক্ষিণে ঢাকা নারায়নগঞ্জ সড়কের পূর্বদিকে শ্যামপুরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিজস্ব জায়গার উপর ”বাংলাদেশে ফাইটোস্যানিটারী সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের” আওতায় কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ নির্মানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিন তলা বিশিস্ট কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়। একই বছরের মে মাস থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আম রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের একমাত্র আর্ন্তজাতিকমানের কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের কার্যক্রম শুরু হয়। একইসাথে অন্যন্য ফলমূল ও শাকসব্জি রপ্তানীর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ থেকে পুরোদমে রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয় এবং কোন রকম Non Compliance ছাড়াই ২০১৭ সালে সফলতার সাথে রপ্তানিকার্য সম্পাদন করে।

কেন্দ্রিয় প্যাকিং হাউজের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে কয়েকটি নতুন আইটেমসহ প্রায় শতাধিক কৃষি পণ্য সফলতার সাথে সর্বনিম্ন Non Compliance-এর মাধ্যমে ইউরোপের ১০টি  দেশে রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ রপ্তানির পরিমান ও পণ্যের সুনাম ঐসব দেশে উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।সকলের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে এবং কৃষি মন্ত্রনালয়, কৃষক ও রপ্তানিকারসহ সংশ্লিষ্টদের পূর্ন সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের পরে রপ্তানির ক্ষেত্রে তাজা শাকসবজি ও ফলমূলের অবস্থান হবে বলে আশা করা যায়।

বছর ভিত্তিক সব্জি, ফল রপ্তানি ও রাজস্ব আহরন


বাংলাদেশ থেকে তাজা শাক সবজি ও ফল রপ্তানির ফলে অর্জিত রেমিটেন্স


রপ্তানিকৃত সবজির নামঃ লাউ, চাল কুমড়া, কচু, মুখী কচু, লতি কচু, কচুর ডোগা, কচুর শাক, কলার থোর, কলার মোচা, কাচা কলা, পেপে,খিরা, মিষ্টি কুমড়া,সীম, সীমের বীচী,কাঠাঁলের বীচী, পেয়াজ পাতা, থানকুনি পাতা, মূলা,শশা, রজত পাতা, পটল, চিচিঙ্গা, কাকরোল, করলা, ধন্দুল, ঢেড়শ, ডাটা, ঝিঙ্গা, চুকর পাতা, বাধা কপি, সজিনা, বেগুন,লালশাক,লাউশাক,ডাটাশাক।

রপ্তানিকৃত ফলঃ আম, কাঠাঁল, জারালেবু, সুপারি, লটকন, জাম্বুরা, তাল, শুকনাবরই, আমড়া, কামরাংগা, জলপাই, পেয়ারা, আমলকি, তেতুল,কাচাতেতুল, বরই, অড়বরই, চালতা, বেল, কদবেল, তৈকর, সফেদা, ডেফল, চুকর ফল, লুকলুকি,কচিডাব, পানিফল, বিলাতিগাব, করমচা, বেত ফল।

অন্যান্য- আঁখ, কাচা হলুদ, ধনিয়া পাতা, বিলাতি ধনিয়াপাতা, নাগা মরিচ, কাঁচা মরিচ।

রপ্তানিকৃত দেশের নামঃ  ১.যুুক্তরাজ্য ২. ইটালি ৩. ফ্রান্স ৪. গ্রিস ৫. জার্মানী ৬.সুইডেন ৭. ফিনল্যান্ড ৮. সুইজারল্যান্ড ৯. অস্টিয়া ১০. নেদারল্যান্ড।

রপ্তানিকৃত কৃষিপণ্যসমূহ ও উৎপাদিত এলাকা


চাষাবাদ কৌশল


উল্লেখযোগ্য-অর্জন সমুহ:

উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ, শ্যামপুর, ঢাকা এর মাধ্যমে ২০১৭ সালে ইউরোপের ১০টি দেশে মান সম্মত উদ্ভিদ ও উদ্ভিদ জাত পণ্য সুষ্ঠুভাবে সটিং, গ্রেডিং করে রপ্তানি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ প্রতিষ্ঠার আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেখানে প্রতিবছর প্রায় ১২০-১৭০ টি Non Compliance Notification হতো সেখানে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ প্রতিষ্ঠার পর প্রতি বছর গড়ে ১০ টির বেশি Non Compliance Notification হচ্ছে না। বিগত ২০১৭-১৮ সাল থেকে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ, শ্যামপুর, ঢাকা, মাধ্যমে ১০০%  কম্পিউটারাইজড পিসি  প্রদান করা কাজ নিশ্চিত করা হয়েছে। রপ্তানির বিভিন্ন বিষয়ে কৃষক/কৃষানী, কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে একটি এক্রিডিয়েটেড ল্যাব স্থাপনের কার্য়ক্রম চলমান রয়েছে। কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ হতে নিজস্ব তালা ও সিলগালা ব্যবহারের মাধ্যমে প্যাকিং হাউজ হতে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত রপ্তানিকৃত পন্য নিরাপদে পরিবহন করা নিশ্চিত কার হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহে তাজা ফলমূল ও শাক সবজির রপ্তানির পরিমান ও পণ্যের গুনগত মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সীমাবদ্ধতা:
বাংলাদেশের কৃষিজাত পণ্যের বিদেশে ব্যাপক চাহিদা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে কাংখিত লক্ষ্য অর্জন কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যহত হচ্ছে। যার মধ্যে কাচা শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদির উৎপাদন পর্যায়ে মান সম্মত উৎপাদন কলাকৌশল গ্রহন না করা, পরিবহন সমস্যা, নিম্নমানের মোড়ক ও প্যাকেটজাতকরণ এবং মান সম্মত পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকা। ভেপার হিট ট্রিটম্যান্ট এর ব্যবস্থা না থাকায় জাপানসহ কয়েকটি দেশে আম রপ্তানী করা যায় না।

কি করলে ঝুঁকি কমবে:
পরিবর্তনশীল বৈরী জলবায়ুর সংগে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে Plant Pathogen-এর ধরন ও গতি প্রকৃতি। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতি মোকবেলা করে “ফুড সেফটি ও ফুড সিকিউরিটি”র বিবেচনায় প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য রপ্তানি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিধি বিধান ও চাহিদা পূরণ স্বাপেক্ষে ক্ষতিকারক সংগনিরোধ রোগ ও পোক-মাকড় মুক্ত নিরাপদ ও ঝুকিমুক্ত মান সম্মত পণ্য রপ্তানি নিশ্চিত করা উদ্ভিদ সংগনিরোধের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সাথে সমন্বয় করে বিমান ভাড়া নির্ধারণ প্রয়োজন। কর্মকর্তা কর্মচারীদের দেশে ও বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। রপ্তানীকারক ও অফিসিয়াল জনবল দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।

উপসংহার:
আগামী দিনের বিশ্ব পরিস্থিতি কি হবে আর আমাদের জন্যই বা কি অপেক্ষা করছে তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। এরই মধ্যে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়ে আগামীতে খাদ্য সংকট হতে পারে মর্মে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে সতর্ক করেছেন। কৃষি মন্ত্রালয়ের দায়িত্বে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয় করোনা কালীণ সময় এ খাদ্য সমস্যা মোকাবিলার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন।আগামী দিনের কৃষিতেও করোনার মতো অজানা রোগজীবাণু সংক্রমণের ভয়াল থাবায় খাদ্য সমস্যা প্রকটতর পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। কৃষি পন্য আমদানী রপ্তানীর জন্য নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করা জরুরি।
 
কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের স্থাপনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইন্টারসেপশনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে কমে যায় তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি বহুগুনে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে করোনাকালীন সময়ে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ থেকে যে পরিমান সবজি ও ফল রপ্তানি হয়েছে তা রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো এর রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। পন্যের গুনগত মান নিশ্চিত হবার কারনে শিপমেন্টের অর্ডার যেমন বৃদ্ধি পায় সাথে সাথে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। রপ্তানি সংক্রাস্ত আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন নির্দেশনা, সিদ্ধান্তসমূহ, বিভিন্ন চুক্তি, পলিসি সংক্রান্ত সকল বিষয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অবহিতকরনের ব্যবস্থা করে চলমান বিশ্বে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সাথে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো পরিস্থিতি নিশ্চিতকরন প্রয়োজন। কার্গো বিমান/ চার্টাড বিমানের ব্যবস্থাসহ বিমানের স্পেস সহজলভ্যকরন করা প্রয়োজন।

এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের সাথে সমন্বয় করে বিমান ভাড়া নির্ধারণ প্রয়োজন। রপ্তানীকারক ও অফিসিয়াল জনবলকে দক্ষ করতে হবে। এক্সপোর্ট কার্গোতে সিভিল এভিয়েশনের যে স্ক্যানিং মেশিন আছে সে এস ও পি Stanndard Operating System)- তে কোয়ারেন্টাইন পার্সোনেল এর কোন এন্ট্রি  নেই। যদি এরাইভাল বা ডিপারচার এ স্ক্যানিং এ কোয়ারেন্টাইন প্রতিনিধি থাকে তা হলে তিনি পিসি (Phytosanitary Certificate ) ছাড়া বা অন্য কোনভাবে পণ্য নিলে তা আটকাতে পারবেন এবং সরকারের রাজস্ব আদায় নিশ্চিত হবে। বিশ্ব বাজারে আমাদের কৃষিপন্য রপ্তানি করতে হলে উৎপাদনকালিন সময়ে Good Agricultural Practices (GAP) নিশ্চিত করা জরুরি, সেইসাথে ঝুঁকিমুক্ত স্বার্থে রপ্তানীর পূর্বে এক্রিডিয়েটেড ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা পুর্ব্বক প্রত্যায়ন/সনদ নেয়া প্রয়োজন। জাপানসহ কয়েকটি দেশে আম রপ্তানি করতে হলে, ভেপার হিট ট্রিটম্যান্ট  (VHT) ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাছাড়া উন্নতমানের প্যাকেটজাতকরণ এবং মান সম্মত পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা থাকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

লেখক:উপপরিচালক (এল.আর),সংযুক্ত
উদ্ভিদ সংগনরিোধ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।
ইমেইল: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.

তথ্য সূত্র: কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ, ঢাকা।