জৈব কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা-প্রেক্ষিত শ্রীলংকার বর্তমান খাদ্য সংকট

মো.শহিদুল্লাহ্:দক্ষিন এশিয়ার সম্ভাবনাময় দেশ শ্রীলংকা আজ খাদ্য জ্বালানীর সংকটসহ নিদারুণ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে। দেশটির নানাবিধ সংকটের মধ্যে খাদ্য সংকট অন্যতম। অথচ শ্রীলংকা একদশক আগেও চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ন ছিল, চা উৎপাদনে ও রপ্তানীতে দক্ষিন এশিয়াতে শীর্ষে অবস্থান ছিল। আজ দেশটির খাদ্য উৎপাদন শতকরা ২০ ভাগের চেয়েও বেশি কমে গেছে। খাদ্য সংকটের জন্য অপরিকল্পিত শতভাগ জৈব পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন ব্যবস্থার প্রবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে।

ভাবনার বিষয় হলো ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিটি দেশের ফসলের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুন করতে হবে। এমতাবস্থায় কম উৎপাদনশীল জৈব কৃষি কি পারবে ক্রমবর্ধমান খাদ্যে চাহিদা মেটাতে? স্বভাবতই জৈব কৃষির সীমিত ফলন এর মাধ্যমে বহুল জনগোষ্ঠির খাদ্যে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়, যার জ্বলন্ত উদাহরণ এক দশক আগে সম্পূর্ন জৈব কৃষির প্রবর্তনকারী দেশ শ্রীলংকার আজ খাদ্যের জন্য হাহাকার। শ্রীলংকা এক দশক পূর্বে বালাইনাশক আমদানী ও উৎপাদন সম্পূর্নরুপে বন্ধ করে দেয় এবং ফসল উৎপাদনে শূন্য বালাইনাশক নীতি গ্রহন করে। ফলশ্রুতিতে, ফসল ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার দরুন বালাইয়ের প্রাদুর্ভাবে ফসলের ফলন বহুলাংশে হ্রাস পায়। সামগ্রিক, উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যা আজ শ্রীলংকার নাগরিকদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যে পন্যের জন্য ডিপার্টমেন্টল দোকানের লাইনে দাড়িয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়।

অনিরাপদ খাদ্যের ডামাডোলে নিরাপদ জৈব কৃষি শব্দটি একটি চমকপ্রদ বহুল আকাংখিত বিষয়। সভ্যতার প্রাক্কালে মানুষ স্বাভাবিকভাবে রাসায়নিকমুক্ত পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করতো। তখন মানুষ ছিল কম, জমি ছিল অফুরন্ত; চাহিদাও ছিল বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক কম। আধুনিক সভ্যতার বিকাশের সাথে জনসংখ্যা বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে, আবাদি জমি বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। খাদ্য চাহিদা মেটাতে মানুষ নিত্য-নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। ফসলের বালাইয়ের ক্ষতির হ্রাসে রাসায়নিকের প্রয়োগ প্রচলন হয়েছে; ফসল উৎপাদন কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। তথাপি বিশ্বে আজও প্রায় একশত কোটি মানুষ অনাহারে দিন কাটায়।

জৈব পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন একটি উচ্চাভিলাষী আবাদ পদ্ধতি। জৈব পদ্ধতিতে অনেক ধরণের নিয়ম-কানুন মেনে ফসল চাষাবাদ করতে হয়। জমি কর্ষন থেকে বীজ বপন ও আন্তপরিচর্যা এবং ফসল কর্তন ও কর্তনোত্তর নানবিধ নিয়ম পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। এ পদ্ধতিতে বেশি ফলন ও উতপাদন মুখ্য বিষয় নয়; এখানে প্রাধান্য পায় মাটির স্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, রাসায়নিকের শূন্য প্রয়োগ সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদী ফসল ব্যবস্থাপনা। ফসলের সাধারন চাষাবাদ ব্যবস্থাপনায় রোগ পোকার উপস্থিতি যখন ক্ষতিকর পর্যায়ে পৌছার পূর্বে রাসায়নিক বালাইনাশক সঠিক পরিমিত পরিমানে নির্ধারিত নিয়ম মোতাবেক ফসলের জমিতে প্রয়োগ করা হয় যাতে আর্থিক ক্ষতি সীমা অতিক্রম না করে। এতে ক্ষতিকর পোকা ও রোগ থেকে ফসল রক্ষা পায়, ফলে ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়।

জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসল বাজারজাতকরনে প্যাকেটের মোড়কে উল্লেখ করা হয় যে পন্যটি জৈব পদ্ধতিতে উতপাদিত এবং এ পন্যের বাজারমূল্য সাধারণ পদ্ধতিতে উৎপাদিত পন্যের চেয়ে চার-পাচ গুন বেশি হয়ে থাকে। যেসব ক্রেতা অধিক দামে জৈব পন্য কিনতে চান, এটি তাদের জন্য একটি অপশন মাত্র। সাধারন জনগোষ্টির ব্যাপক খাদ্য চাহিদা মেটাতে সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনমূখী হওয়া অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ফসল উতপাদন এখন এমনিতেই আগের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। নিত্য-নতুন রোগ পোকার আক্রমনে ফসলহানি ও উতপাদন হ্রাস এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।

খাদ্য রাজনীতি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয় যেখানে কোন দেশ কোন ধরনের ঝুকি নিতে আগ্রহী হয় না। নিকট অতীতে ২০০৮ সালে যখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় সারা পৃথিবি জুড়ে খাদ্য সংকট দেখা দেয় তখন দেখা যায় খাদ্য পন্য রপ্তানীকারক দেশসমূহ নিজেদের ভবিষ্যতে কথা ভেবে খাদ্যপন্য রপ্তানী সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করে দেয়। তখন স্বাভাবিক দামের চেয়ে দ্বিগুন-তিনগুন দাম অফার করেও খাদ্য আমদানি করা যায়নি। এটা ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা সকল দেশের জন্য। শ্রীলংকা বড় ঝুকি নিয়ে ভবিষ্যত খাদ্য উৎপাদনের কথা না ভেবে তাতক্ষনিক টোটাল খাদ্য উতপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন করেছে, যা মোটেই জনবান্ধব নীতি নয়।

ফসলে বালাইনাশক প্রয়োগ একটি বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি। আমরা অনেকেই কীটনাশকের কথা শুনলে শিহরিয়ে উঠি। কিন্তু, যথাযথ পদ্ধতিতে বালাইনাশক প্রয়োগ করলে জনস্বাস্থ্যের-হানি ঘটে না এবং পরিবেশে বিরুপ প্রভাব পড়ে না। অধিকন্তু, ক্ষতিকর রোগ পোকা থেকে ফসল রক্ষা পায় এবং বেশি ফলন পাওয়া যায়। দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে বালাইনাশেকর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

বালাইনাশকের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন কৃষকের বালাইনাশক সম্পর্কিত জ্ঞান বৃদ্ধি ও অর্জিত জ্ঞানের আন্তরিক প্রয়োগ। কৃষকের বালাইনাশক প্রয়োগ দক্ষতা বৃদ্ধিকরণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সারাদেশব্যাপী নানা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলমান। বালাইনাশক প্রয়োগকালীন নিয়ম পালনে অধিকাংশ কৃষকের আন্তরিকতা ও দক্ষতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এটি পরিবর্তনে কৃষকের যথাযথ বালাই ব্যবস্থাপনায় নিবিড় প্রশিক্ষন প্রয়োজন। এছাড়া বালাইনাশক পরিবেশকদের অধিক মুনাফা লোভী মনোভাব কৃষকদের অতিরিক্ত বালাইনাশক প্রয়োগে প্ররোচিত করে। কৃষক অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়ে অহেতুক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। বালাইনাশক ডিলারদের প্রতি বোতল বা প্যাকেট বালাইনাশক বিক্রি লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন। এজন্য একটি সহজে ব্যবহারযোগ্য সফটওয়্যার তৈরি করা প্রয়োজন যেন কৃষক ও বালাইনাশক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বালাইনাশক ব্যবহারের দৈনন্দিন চিত্র পেতে পারে। একই সাথে, রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক প্রয়োগের প্রসারে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

আশার কথা হলো, কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকার জৈব বালাইনাশক রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজতর করেছে যাতে বালাইনাশক বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান অধিক পরিমানে জৈব বালাইনাশক উৎপাদন ও আমদানীতে উৎসাহিত হয়। বালাইনাশকে তাই আতংক নয়, সচেতনতা জরুরী। দেশের আপামর জনগোষ্ঠির খাদ্য নিরাপত্তাবিধানে জৈব কৃষি কখনো ফলদায়ক নয়।

লেখক: অতিরিক্ত উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা
ইমেইল: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.