আগামী ৬৩ বছরের মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চাষযোগ্য কোনো কৃষি জমি অবশিষ্ট না থাকার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা

Category: ফোকাস Written by Shafiul Azam

এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম: এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম: অপরিকল্পিত রাসায়নিকের ব্যবহার এবং মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি ও মৎস্য খাত অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ছে। মাটির এই অবক্ষয় রোধ করা না গেলে আগামী ৬৩ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে চাষযোগ্য কোনো কৃষি জমি অবশিষ্ট না থাকার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আজ মঙ্গলবার খুলনার সিএসএস আভা সেন্টারে সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া এবং উত্তরণ এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক কর্মশালায় এই আশঙ্কার কথা উঠে আসে। ‘Soil and Water Quality Assessment of Rejuvenated Micro-Watersheds in Southwest Bangladesh Implications for Agriculture and Aquaculture” শীর্ষক এই কর্মশালায় কৃষিবিদ, গবেষক, উন্নয়নকর্মী ও কৃষক প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

কর্মশালার শুরুতে কৃষিবিদ মোস্তফা নূরুল ইসলাম দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি ও সুপেয় পানির সংকটের চিত্র তুলে ধরেন। মাটির উর্বরতা রক্ষায় তিনি রাসায়নিক সারের যথেচ্ছা ব্যবহার বিরত থাকার জন্য কৃষকদের অনুরোধ করেন। কৃষিবিদ মোস্তফা সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের ৬টি উপজেলায় মাইক্রো-ওয়াটারসেড খনন/পুনঃখননের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি জমির উর্বরতা রক্ষায় সার সুপারিশ কার্ডে বর্ণিত সার ফসল ক্ষেতে ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করেন। তিনি মাটির উর্বরতা রক্ষায় এবং কমিউনিটি পরিচালিত পানি ব্যবস্থাপনায় প্রকল্পের অগ্রগতি অবহিত করেন। তিনি আরও বলেন প্রকল্পটির অন্যতম একটি উপাদান হলো ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে এনে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করা।

কর্মশালায় সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক-এর সিনিয়র প্রেগ্রাম অফিসার কৃষিবিদ ড. এস এম ফেরদৌস প্রকল্পভুক্ত উপজেলার মাটির বর্তমান পুষ্টিমান নিয়ে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা করেন। তিনি ৬টি উপজেলার মাটি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখান। তিনি কৃষকদের সতর্ক করে বলেন, মাটির স্বাস্থ্য না জেনে যত্রতত্র সার প্রয়োগ করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সার সুপারিশ কার্ড ছাড়া কোনোভাবেই জমিতে সার ব্যবহার করা উচিত নয়।

মাটির অবক্ষয় নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল, ওয়াটার এন্ড ওয়াটার ডিসিপ্লিন এর প্রফেসর মোঃ সানাউল্যাহ পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন। মাটিতে যথেচ্ছা রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে, সার সুপারিশ কার্ড মোতাবেক ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, মাটির গুণাগুণ কমতে থাকায় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল আজ হুমকির মুখে।” তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, মাটির অবক্ষয় ও অপব্যবহার চলতে থাকলে আগামী ৬৩ বছরের মধ্যে কৃষি কাজ করার মতো কোনো জমি আর অবশিষ্ট থাকবে না। প্রফেসর সানাউল্লাহ আরও বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) প্রতিটি লক্ষ্যের সাথেই মাটির উর্বরতা বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ আছে। তিনি সলিডারিডাডের সার সুপারিশ কার্ডের মাটিতে বিদ্যমান উদ্ভিদ পুষ্টিমান বিষয়ে আলোচনাকালে বলেন, এঅঞ্চলের মাটিতে ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিংক ও বোরণের মাত্রা উচ্চ থেকে অতিউচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।

উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনার উপপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ নজরুল ইসলাম, সাতক্ষীরার উপপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ সাইফুল ইসলাম ও বাগেরহাটের মোঃ মোতাহার হোসেন, ও বাগেরহাটের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মুরাদ, ড. নাজিয়া, কৃষক প্রতিনিধি চিতলমারীর রীনা হীরা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল কুমার সেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের সুমন, কৃষাণী রীনা রানী হীরা প্রমুখ।

মাইক্রো-ওয়াটাসেডের পানির মান সম্পর্কে আলোচনায় কেমিস্ট, আবু মোঃ শামীম হাইড্রো-ইকোলজিক্যাল বা জল-প্রতিবেশগত গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। প্রসঙ্গতঃ কেমিস্ট আবু মোঃ শামীম হাইড্রো-ইকোলজিক্যাল বা জল-প্রতিবেশগত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। তিনি খাদ্যে বিষক্রিয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বর্তমানে শাক-সবজিতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। তাই রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং আগাছানাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।

বাপাউবো এর নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল কুমার সেন। খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যারে পরিকল্পনা করার প্রস্তাব করেন তিনি বলেন, পানির গুণাগুণ সরাসরি খাদ্য নিরাপত্তার সাথে জড়িত। দূষিত পানি ও মাটি মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে, তাই এ বিষয়ে আরও বিশদ গবেষণার প্রয়োজন।

প্রফেসর মাসুদুর রহমান বলেন, মাইক্রো-ওয়াটারশেড বা ক্ষুদ্র জলাধারগুলোর ক্যাচমেন্ট এলাকায় মানবসৃষ্ট হস্তক্ষেপের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি ইকো-সিস্টেম পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, মাইক্রো-ওয়াটারশেডগুলোর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হলে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে অপারেশনাল বা কাঠামোগত পরিবর্তন ও পরিমার্জন আনা খুবই আবশ্যক।

সকল আলোচক ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর জন্য আরও খাল খননের প্রস্তাব করেন। খননকৃত খালের পরিচালনা ও রক্ষাবেক্ষণের জন্য এলাকাবাসীকে মটিভেট করার জন্য একমত হন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি ও মৎস্য খাতকে বাঁচাতে হলে এখনই মাটি ও পানির গুণাগুণ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং কৃষকদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে বলে সকল আলোচক একমত হন। কর্মশালায় সলিডারিডাডের ঢাকা অফিসের পরামর্শক উৎপল কুমার, উত্তরণ এর প্রজেক্ট ম্যানেজার কৃষিবিদ ইকবাল হোসেন, মনিটরিং ও ইভালুয়েশন অফিসার মোঃ সজীব আলী, কমিউনিকেশন অফিসার আরিফ বিল্লাহ, ট্রেনিং অফিসার কৃষিবিদ নাবিলা আজহার, প্রোগ্রাম অফিসার কৃষিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান, সুব্রত রায়, উত্তরণ এর ওয়াটার ক্লাস্টার অফিসারগন এবং ১৮ জন কৃষক কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন।