বাকৃবি প্রতিনিধি: আর কয়েকদিন পরই সারা দেশে উদযাপিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। এই ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পশু কোরবানি করে থাকেন। এ সময় কোরবানির উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন হাটে লাখ লাখ গবাদিপশু কেনাবেচা হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সবসময় সুস্থ ও ভালো পশু কোরবানি দিতে আগ্রহী থাকেন। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে অনেক ক্রেতা প্রতারিত হয়ে অসুস্থ, রোগগ্রস্ত কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক পশু কিনে ফেলেন, যা ইসলামি বিধানের বিরোধী।
সুস্থ পশু শনাক্ত করতে হলে তার শারীরিক গঠন, ত্বকের অবস্থা, চোখ, দাঁত, নখ ও শিং ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। যদিও দাঁত ও শিং দেখে বয়স নির্ধারণে অনেক সময় বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। কোরবানির সময় সংক্রামক রোগ যেমন এলএসডি, অ্যানথ্রাক্স, ব্রুসেলোসিস ও এফএমডি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া পশু পরিবহনের সময় নিষ্ঠুর আচরণ মাংসের গুণগত মান নষ্ট করে এবং প্রাণিকল্যাণ আইনেরও লঙ্ঘন ঘটে। পাশাপাশি, কিছু ব্যবসায়ী দ্রুত পশুকে মোটা করার উদ্দেশ্যে ব্রয়লার মুরগির ফিড খাওয়ান, যা পশু ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও ইন্টার ডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটির (আইআইএফএস) পরিচালক এবং ভেটেরিনারি ডক্টর'স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ- ভ্যাব এর প্রেসিডেন্ট ড. মো. মাহবুব আলম এক সাক্ষাৎকারে কোরবানির হাটে পশু আনা থেকে শুরু করে কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সামগ্রিক বিষয়ের বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
প্রশ্ন- পশু পরিবহনের সময় অনেক অমানবিকতার দৃশ্য দেখা যায়- এই চাপ কি পশুর মাংসের গুণমানের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে?
অধ্যাপক মাহবুব- গাদাগাদি করে পশু পরিবহন করলে স্ট্রেসের কারণে কর্টিসল, অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণ হয় যা গ্লাইকোজেন ক্ষয় করে মাংস শক্ত বা কোমল করে তোলে। তাই স্ট্রেসমুক্ত পরিবহন নিশ্চিত করা প্রয়োজন যাতে পশুর মাংসের গুণমান অক্ষুন্ন থাকে।
প্রশ্ন- পশু পরিবহনে প্রাণী কল্যাণ আইন লংঘন করলে কিরূপ শাস্তি হতে পারে?
অধ্যাপক মাহবুব- বাংলাদেশে পশু পরিবহনের সময় পশু কল্যাণ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা জরিমানা এবং ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। নির্যাতনের মাত্রা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদি নিষ্ঠুরতা অত্যন্ত গুরুতর হয়, তাহলে জরিমানাসহ সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
প্রশ্ন- সুস্থ পশু নির্বাচনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কী?
অধ্যাপক মাহবুব- সুস্থ পশু সচল, চঞ্চল, জাবর কাটে, নাক ও মাজল ভেজা থাকে, পিঠের কুঁজ মোটা ও চামড়া টানটান থাকে। চোখ উজ্জ্বল, খাদ্যে আগ্রহী ও স্বাভাবিকভাবে মলমূত্র ত্যাগ করে। অসুস্থ পশু দুর্বল, নিস্তেজ, কম খায়, মুখ দিয়ে লালা পড়ে এবং কান নিচের দিকে ঝুলে থাকে।
প্রশ্ন- স্টেরয়েড খাওয়ানো গরু চেনার উপায় কী?
অধ্যাপক মাহবুব- স্টেরয়েড প্রয়োগে গরু শান্ত থাকে, হাঁপায়, ক্লান্ত দেখায় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে চাপে দেবে যায়। চকচকে চামড়ার গরু ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়ে থাকতে পারে। এ ধরনের গরুর উরুতে অতিরিক্ত মাংস দেখা যায়। শরীরে চাপ দিলে দেবে যায়। এছাড়া দেশি গরু কেনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বিদেশি গরুর সঙ্গে সংক্রামক রোগ আসার ঝুঁকি থাকে।
প্রশ্ন- পশুর শারীরিক গঠন, ত্বক, চোখ বা ক্ষুর দেখে কোন কোন রোগ নির্ণয় করা যায়?
অধ্যাপক মাহবুব- শরীরের গঠন, হাঁটার ভঙ্গি বা অবস্থান দেখে হাড় বা পেশির সমস্যার ধারণা পাওয়া যায়। চর্মরোগ যেমন চুলকানি, ছত্রাক সংক্রমণ বা অ্যালার্জির সমস্যা চামড়ার কিছু অংশ ঘষে করে নির্ণয় করা যায়। এছাড়া পশুর বিশেষ করে গরুর ক্ষেত্রে চামড়ায় গুটির মতো ফোলা ফোলা ছোট ছোট গোটা দেখে এলএসডি রোগ নির্ণয় সম্ভব হবে। ক্ষুরের অস্বাভাবিকতা, যেমন খুব মোটা ও বাঁকা হওয়া শরীরের ভেতরের কোনো রোগের লক্ষণ হতে পারে। চোখের রোগ যেমন লালচে চোখ কর্নিয়ার ক্ষত চোখ দেখে বোঝা যায়।
প্রশ্ন- দাঁত ও শিং দেখে বয়স নির্ধারণ কতটা নির্ভরযোগ্য? কীভাবে এর ভুলচুক এড়ানো যায়?
অধ্যাপক মাহবুব- দাঁতের মাধ্যমে বয়স নির্ধারণের প্রচলিত নিয়ম থাকলেও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হলো খামারের রেকর্ড। সাধারণভাবে দাঁতের পরিবর্তন ও শিংয়ের রিং গণনা করে আনুমানিক বয়স নির্ধারণ করা যায়।
প্রশ্ন- গরুকে মোটাতাজা করতে অনেক সময় ব্রয়লারের ফিড খাওয়ানো হয়। এটি কি গরুর জন্য ক্ষতিকর?
অধ্যাপক মাহবুব- গরুকে ব্রয়লার ফিড খাওয়ানো মারাত্মক বিপজ্জনক। অনেক খামারি মনে করেন মুরগির ফিড খাওয়ালে গরু মোটা হয় কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। এই ফিডের কারণে গরুর চামড়ার নিচে পানি জমে যার ফলে গরুকে নাদুস-নুদুস দেখায় কিন্তু জবাই করার পর দেখা যায় মাংস হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো চুপসে যায় এবং ওজনও কম হয়। মুরগি ও গরুর হজম প্রক্রিয়া ভিন্ন হওয়ায় গরু এই ফিড হজম করতে পারে না, ফলে কিডনি, লিভার, ফুসফুসে পানি জমে এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ব্রয়লার ফিডে থাকা উচ্চ প্রোটিন, এনার্জি ও স্টার্চ গরুর দেহে অতিরিক্ত তাপ, চর্বি ও মেটাবলিক হিট তৈরি করে, যা হিটস্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও পেটের নানা সমস্যার কারণ হয়। এই ফিডে থাকা উপাদান গরুর মাংসের মানও নষ্ট করে। নিরাপদ মোটাতাজাকরণে গরুর জন্য উপযুক্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবহার জরুরি।
প্রশ্ন- কোরবানির মৌসুমে পশুতে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। সচেতনতা ও প্রতিরোধে কী কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
অধ্যাপক মাহবুব- কোরবানির আগে টিকাদান, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রোগী পশুকে আইসোলেশন ও কোরেন্টাইন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। গণসচেতনতা ও ভেটেরিনারি টিম সক্রিয় রাখতে হবে।
প্রশ্ন- পশুর চামড়া ছাড়ানোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কি এবং এটি কেনো জরুরি?
অধ্যাপক মাহবুব- আমাদের দেশে কোরবানির পর পশুর চামড়া বিক্রি করা হয় যা পরবর্তীতে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। তাই চামড়া ছাড়ানোর সময় কোনো ভুল হলে এটি আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্যই ক্ষতির কারণ হবে। প্রথমে পশুটিকে পরিষ্কার সমতল মাটিতে চিত করে শোয়াতে হবে। চামড়া ছাড়ানোর ক্ষেত্রে ভোঁতা ছুরি ব্যবহার করা ভালো। পশু জবাই করার সময় আমরা পা বেধে রাখি। যত দ্রুত সম্ভব পায়ের বাঁধন খুলে দিতে হবে এতে পশু বেশি নড়াচড়া করবে এবং রক্তের প্রবাহ ভালো হবে। এর মাধ্যমে মাংসের গুণগত মানও বজায় থাকবে চামড়া ছাড়ানোও সহজ হবে।
প্রশ্ন- কোরবানির পর সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় করণীয় কি?
অধ্যাপক মাহবুব- সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার অভাবে পশুর রক্ত ও উচ্ছিষ্টাংশ থেকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনা রয়ে যায়। আর বর্জ্য থেকে বিভিন্ন রোগবালাই ঘড়ানোর আশঙ্কা তো থাকেই। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যদি কুরবানির পশুর বর্জ্য যথাযথভাবে পরিষ্কার করা না হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবেই নানারকম মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। পশু জবাইয়ের আগে নির্ধারিত স্থানে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। নাড়ি-ভুঁড়ি, হাড় ও অন্যান্য অংশ ব্যবহার করে মাছের খাদ্য, সার ও ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করা সম্ভব। এককভাবে না করে, সম্মিলিতভাবে কোরবানি করলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহজ হয়।
প্রশ্ন- কোরবানিতে নিযুক্তদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা কেমন হওয়া উচিত?
অধ্যাপক মাহবুব- মাংস কাটাকাটি ও চামড়া ছাড়ানোর সময় গ্লাভস, মাস্ক, জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার জুতা ব্যবহার করতে হবে। কাজের আগে ও পরে সাবান ও হালকা গরম পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ও শরীর ধুতে হবে। হাঁচি-কাশি থেকে বিরত থাকা, দূরত্ব বজায় রাখা এবং ভিড় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি।