পেট-এর বিখ্যাত সার্জন: ডা. আরিফের যাদুকরী হাতের গল্প!

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম:"কুকুর-বিড়ালের চিকিৎসক (ডাক্তার)!" এই ডাকে কারও হয়তো খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি চীফ ভেটেরিনারি অফিসার ড. মো: হেমায়েতুল ইসলাম আরিফের গর্ব হয়। কেন? কারণ এই ডাকের পেছনে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ সাফল্যের গল্প, যে গল্প তাঁকে এনে দিয়েছে ‘কুকুরের বিখ্যাত সার্জন’ খেতাব! চলুন শোনা যাক সেই মজার ও অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা।

লিলির জরুরি অবস্থা:

সেদিন ছিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখের এক সকাল। ডা. আরিফ অফিসে কাজ করছেন, এমন সময় ফোন এল তাঁর স্কুলের সিনিয়র ভাই মো আতিকুর রহমান লাবু (ডা. আরিফের ভাষায় ‘লাবু ভাই’) কাছ থেকে। সমস্যা? লাবু ভাইয়ের প্রিয় পোষা কুকুর লিলির ডেলিভারি হচ্ছিল না। লাবু ভাইয়ের মেয়ের আত্মার টান লিলির প্রতি। তাকে নিয়ে তিনি ছুটে এলেন ডা. আরিফের নারিকেলবাড়ীয়া ভেটেরিনারি ক্লিনিকে।

সিদ্ধান্ত: সিজার ছাড়া উপায় নেই!

ডা. আরিফ প্রাথমিক পরীক্ষা করেই বুঝলেন, লিলির জন্য সিজারিয়ান সেকশন (সিজার) করানো ছাড়া বিকল্প নেই। মজার বিষয়, লাবু ভাই একদম হতবাক হলেন না! এর আগে ঈদের পুনর্মিলনীতে ডা. আরিফের কাছেই তিনি জেনেছিলেন, মানুষের মতো কুকুরেরও সিজার সম্ভব। ডা. আরিফ লিলির জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রেসক্রিপশন দিলেন।

অপ্রত্যাশিত বাধা ভাত-কইয়ের আড্ডা:

কিন্তু মানসিক চাপে থাকা লাবু ভাই ওষুধ আনতে গিয়ে গাড়ি এক্সিডেন্ট করলেন! প্রায় দু’ঘণ্টা দেরি হয়ে গেল। শেষমেশ পৌনে দুটোর দিকে তিনি ফিরলেন। দুর্ঘটনায় শারীরিকভাবে তেমন ক্ষতি না হলেও মানসিক চাপ কাটাতে ডা. আরিফের প্রস্তাব: "চলুন, একসাথে দুপুরের খাবার খাই।" আর সেদিন দু’বন্ধু (সিনিয়র ভাই) কই মাছ দিয়ে ভাত খেলেন, ক্লিনিকেই।

ইতিহাসের সূচনা: প্রথম কুকুর সিজার!

তারপর এল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ডা. আরিফের অফিসের জিয়া, পিএইচডি ফেলো কৃষিবিদ মো: ইসমাইল হক এবং লাবু ভাইয়ের সহায়তায় প্রস্তুতি নেওয়া হলো। প্রায় আড়াই ঘণ্টার এক টেনশনপূর্ণ অথচ দক্ষ অপারেশনের পর এলো সাফল্যের মুহূর্ত! লিলির জঠর থেকে একে একে বেরিয়ে এল সাতটি সুস্থ-সবল পোষা কুকুরছানা! ডা. আরিফ এর আগে অসংখ্য ছাগল, ভেড়া ও বিড়ালের সিজার করলেও কুকুরের সিজার এটাই ছিল তাঁর প্রথম। এক ভিন্ন, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!

ফেসবুক থেকে প্রথম আলো: খ্যাতির সূচনা!

অন্যান্য কাজের মতোই ডা. আরিফ সেদিন ফেসবুকে লিলি ও তার সাত বাচ্চার ছবি পোস্ট করলেন। সেই পোস্টটি তাঁর এক চিকিৎসক ছোট ভাই ডা. আশফাকের নজরে পড়ে। তিনি সেটি শেয়ার করলেন নিজের পেজে। এরপর কী হল? রাজশাহীর এক দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকের নজর পড়লো এই অসামান্য কীর্তির খবরে! তিনি ডা. আরিফের সাক্ষাৎকার নিতে চাইলেন।

পরদিন সকালে ‘সোনার দেশ’ পত্রিকার সেই সাংবাদিক এবং ‘প্রথম আলো’র ফটো সাংবাদিক ক্লিনিকে হাজির। লিলি ও তার বাচ্চাদের ছবি তোলা হলো, ডা. আরিফের কাছ থেকে শোনা হলো পুরো অপারেশনের বর্ণনা। আর তার পরদিনই? বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকপ্রথম আলোতে প্রকাশিত হলো লিলির সাত বাচ্চার ছবিসহ অপারেশনের বিস্তারিত বর্ণনা! 

 "বাংলাদেশের প্রথম কুকুর সার্জন!"

এই প্রকাশনার পরেই শুরু হলো অভিনন্দনের ঝড়! ফোনের পর ফোন। বন্ধু-আত্মীয়-পরিচিত সবাই অভিনন্দন জানাতে লাগলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় তথ্য দিলেন প্রথম আলোর সেই সাংবাদিকই। তাঁর খোঁজ অনুযায়ী, সম্ভবত বাংলাদেশেই ডা. আরিফই প্রথম কোনো সার্জন যিনি সফলভাবে একটি কুকুরের সিজার অপারেশন সম্পন্ন করলেন!

ডাক নাম: "কুকুরের বিখ্যাত সার্জন!"

এই সাফল্য ডা. আরিফকে দিয়েছে এক অনন্য পরিচয়। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সুধীজন এখন তাকে পরিচয় করিয়ে দেন গর্বভরে: "ইনি সেই বিখ্যাত কুকুরের সার্জন, যার সিজারের কথা প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল!" পরিচিত মহলে তিনিই এখন ‘কুকুরের বিখ্যাত সার্জন’।

গর্বের কথা:
ডা. আরিফের কথায়, "জানেন- কুকুর, বিড়াল গরু বা মুরগীর ডাক্তার বলে কেউ যখন আমাকে ডাক দেয় তখন খারাপ লাগার পরিবর্তে আমার খুব গর্ব হয়।" লিলির সফল অপারেশন এবং সাতটি প্রাণ বাঁচানোর আনন্দ এই গর্বকে আরও তরান্বিত করেছে।

শেষ কথা:

ড. মো: হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ শুধু একজন দক্ষ ভেটেরিনারি সার্জন নন, তিনি প্রমাণ করেছেন যে অধ্যবসায়, দক্ষতা এবং প্রাণিপ্রেমের সমন্বয়ে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। তাঁর এই যুগান্তকারী কাজ কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নারিকেলবাড়ীয়া ভেটেরিনারি ক্লিনিকেরই নয়, বাংলাদেশের সমগ্র পশুচিকিৎসা ক্ষেত্রের জন্য একটি উজ্জ্বল মাইলফলক। 'কুকুরের বিখ্যাত সার্জন' – এই উপাধিই এখন তাঁর কাজের প্রতি দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক।