
কৃষিবিদ ডাঃ শাহাদাত হোসেন পারভেজ: শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম বাংলাদেশের এক ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্ব। জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান জিয়াউর রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় জাতির চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আগমন। এরপর রণাঙ্গনে যুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধ প্রশাসনের নীতিনির্ধারণে অসামান্য অবদান রেখে আপামর জনমানসে স্থান করে নেন এক মহানায়কের আসনে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় সমাসীন হন এবং ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ পরিচালনা করেন। দেশের ইতিহাসে তার শাসনামল (১৯৭৫-১৯৮১) এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। স্বল্প সময়ের শাসনামলে নানা সঙ্কটে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করে জিয়া ইতিহাসে নিজের অক্ষয় স্থান নিশ্চিত করেন।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, সময়োপযোগী গতিশীল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অবস্থান ও গতিপথ নির্ধারণ এসব বহুমাত্রিক সাফল্যের কথা সুবিদিত এবং বহুল চর্চিতও। তবে আজকের নিবন্ধের বিষয়বস্তু কৃষির উন্নয়নে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভূমিকা। শহীদ জিয়া ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। এ দেশের গরিব মেহনতি মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ছিল তার অন্যতম জীবন সাধনা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল ধ্বংসস্তূপে পরিণত। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, কৃষি উৎপাদন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, আর খাদ্য ঘাটতি ছিল নিত্যসঙ্গী। এমন এক অনিশ্চিত সময়ে দায়িত্ব নেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান- একজন মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, রাষ্ট্রনায়ক এবং জনবান্ধব নেতা।
তিনি উপলব্ধি করেছিলেন স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আত্মনির্ভর অর্থনীতি অপরিহার্য, আর তার মূলে আছে কৃষি। তাই কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও পল্লী উন্নয়নকে তিনি জাতীয় উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে শুরু হয় এক বাস্তবমুখী সবুজ বিপ্লবের যুগ।
কৃষি বিপ্লবের স্থপতি জিয়াউর রহমান
খাল খনন কর্মসূচি- সেচ ও উৎপাদনের বিপ্লবঃ কৃষি উৎপাদনে সেচের গুরুত্ব অপরিসীম। সেচের জন্য এ দেশের কৃষকরা প্রধানত বৃষ্টির পানির ওপরই নির্ভরশীল ছিলেন। ১৯৭১ সালে আবাদি জমির মাত্র ১৫ শতাংশ সেচের আওতায় ছিল। সেচের জন্য বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর তাগিদ থেকে কৃষি খাতে উন্নতির লক্ষ্যে জিয়া সরকার ব্যাপকভিত্তিক ‘খাল খনন কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে খরা মৌসুমে কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন। খাল খনন কর্মসূচিকে জিয়াউর রহমান একটি ‘বিপ্লব’ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৯-৮১ সাল পর্যন্ত পরিচালিত খাল খনন কর্মসূচি ছিল জিয়াউর রহমানের যুগান্তকারী উদ্যোগ। ২৬,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খননের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের কৃষিতে সেচ ব্যবস্থার বিপ্লব ঘটান। এ কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল- উপরিভাগের পানি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমানো, কৃষিতে সেচ সম্প্রসারণ, মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। উলশী গ্রামের মাটিতে স্বেচ্ছাশ্রমে নিজ হাতে কোদাল চালিয়ে এই কর্মসূচির সূচনা করেন তিনি। এজন্যই কৃষক সমাজ তাঁকে ভালোবেসে ডাকত “রাখাল প্রেসিডেন্ট” নামে।
কৃষি সংস্কার ও যান্ত্রিকীকরণঃ জিয়া কৃষিকে আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপ দিতে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করেন। তার আমলে প্রণীত ১৯৭৭ সালের বীজ অধ্যাদেশ কৃষি আধুনিকায়নের ভিত্তি স্থাপন করে। কৃষি উপকরণ বিতরণ ব্যবস্থা সংস্কার করে কৃষকদের জন্য সার, সেচযন্ত্র ও ট্রাক্টর সহজলভ্য করেন। গ্রামে যৌথ খামার ও সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করেন।১৯৮০ সালের জুলাই মাসে জিয়া সরকার দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রবর্তন করেন। এ পরিকল্পনারও প্রধান লক্ষ্য ছিল কৃষিখাতের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ও বিকাশ। এ লক্ষ্যে কৃষি পদ্ধতির দ্রুত রূপান্তরের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষির যান্ত্রিকীকরণ এবং জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। কৃষিতে সব থেকে বেশি ভর্তুকি এবং সুলভ মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবস্থাসহ সার ও কীটনাশকের মূল্য কৃষকের নাগালের মধ্যে রাখা হয়। তিনি কৃষিকে শুধুমাত্র উৎপাদন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পুনর্জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছিলেন।
কৃষি ঋণ, গুদাম ও খাদ্য নিরাপত্তা নীতিঃ ১৯৭৪ সালের অনুরূপ দুর্ভিক্ষ যেন না হয় সে জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যশস্য মজুদের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্যে চাষিদের কাছ থেকে ধান-চাল ক্রয়ের ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও জোরদার করা হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি গঠন করেন “বিশেষ কৃষি ঋণ তহবিল”- ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে প্রান্তিক কৃষকদের জামানতবিহীন ঋণ প্রদান শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে চালু করেন শস্য গুদাম ঋণ কর্মসূচি, যাতে কৃষকরা ফসল গুদামে রেখে প্রয়োজনমতো বিক্রি করতে পারেন। খাদ্য নিরাপত্তায় গড়ে তোলেন বৃহৎ জাতীয় খাদ্য মজুতব্যবস্থা, কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান-চাল ক্রয় নিশ্চিত করেন। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে রেকর্ড ১.০৩ মিলিয়ন টন চাল সংগ্রহ হয়, এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চাল রপ্তানি সম্ভব হয়।
ভূমি সংস্কার ও সামাজিক ন্যায়বিচারঃ ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে পেশ করা ভূমি সংস্কার প্রস্তাবে তিনি কৃষিজমির সীমা নির্ধারণ, বর্গাচাষ আইন, খাসজমির বণ্টন এবং ভূমিকর পুনর্গঠন প্রস্তাব করেন। এর লক্ষ্য ছিল- প্রকৃত কৃষকের হাতে জমি পৌঁছে দেওয়া এবং উৎপাদন বাড়ানো। রাষ্ট্রপতি জিয়া বর্গাচাষিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেন। অন্যান্য ব্যবস্থার সাথে খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদানে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। জমি বন্ধক দিতে হতো না বলে বর্গাচাষিরাও কৃষিঋণ নিতে পারতেন। কৃষি উৎপাদনে সমবায় পদ্ধতির প্রচলনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। জিয়া সরকারের গৃহীত এসব কৃষিবান্ধব কর্মসূচির ফলে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং পরপর দুই বছর বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়।
গবেষণা, সার ও চিনি শিল্পে আধুনিকায়নঃ জিয়াউর রহমানের আমলে আশুগঞ্জ সার কারখানা (১৯৮১) বার্ষিক ৫.২৮ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে চালু হয় যা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) প্রতিষ্ঠা করে ফসল গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। গম গবেষণা কেন্দ্র (দিনাজপুর, ১৯৮০) প্রতিষ্ঠা করে তিনি আমদানি নির্ভরতা কমানোর পদক্ষেপ গ্রহন করেন। চিনি শিল্প উন্নয়নে (১৯৭৬) সালে “বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন” গঠন করে চিনি শিল্পকে আধুনিক রূপ দেন।
পাট, রেশম, রাবার উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে পদক্ষেপঃ সোনালি আঁশ নামে খ্যাত পাটচাষ সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা হয়। কৃষক যেন পাটের ন্যায্যমূল্য পান সে জন্য মূল্য নির্ধারণসহ নানা কার্যকর ব্যবস্থা করা হয়। বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রফতানি বৃদ্ধির জন্য পাটকলগুলোতে উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। জিয়ার আমলে এ দেশে রেশম ও রাবার উৎপাদন সম্প্রসারণ করা হয়।
পল্লী বিদ্যুতায়ন ও গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিঃ ১৯৭৭ সালে শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটায়। সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিদ্যুতের সরবরাহ উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
বৃক্ষরোপণ ও ফল-সবজি চাষে জনগণকে সম্পৃক্তকরণঃ জিয়া জনগণকে বাড়ির আঙিনা, রাস্তার ধারে ও পতিত জমিতে ফল ও সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিবেশ সংরক্ষণ ও কৃষি বৈচিত্র্যে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।
পল্লী উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানঃ যুব মন্ত্রণালয় (১৯৭৮) ও যুব উন্নয়ন কেন্দ্র (১৯৮১) প্রতিষ্ঠা করে যুবকদের উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ দেন জিয়াউর রহমান। বার্ড, আরডিএ ও সিআইআরডিএপি- এই তিন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়নের টেকসই মডেল গড়ে তোলেন, যা আজও প্রভাবশালী।কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত ও সংরক্ষণে কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য ছয় হাজার বেকার যুবককে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এমনকি তারা যেন নিজ এলাকায় ছোটখাটো প্রকৌশল শিল্পপ্রতিষ্ঠা করতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ এবং যন্ত্রপাতি সংগ্রহের সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
দেশ গঠন ও কৃষির উন্নয়নে ১৯ দফা কর্মসূচিঃ ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি কালজয়ী অবদান। রাষ্ট্রনীতিবিদরা এ ১৯ দফা কর্মসূচিকে একটি যুগোত্তীর্ণ ‘ভিশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জিয়াউর রহমান এ কর্মসূচি নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক গণসংযোগ করেন। চার সপ্তাহের জনসংযোগ কর্মসূচিতে তিনি ৭০টি জনসভায় ১৯ দফা কর্মসূচির যৌক্তিকতা সম্পর্কে তার বক্তব্যে তুলে ধরেন। ১৯ দফা কর্মসূচির ৩ নং দফায় সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে গঠন করা, ৫ নম্বর দফায় ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতি জোরদার করা’ এবং ৬ নম্বর দফায় ‘দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন করা এবং কেউ যেন ভুখা না থাকে’, তার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচীঃ স্বনির্ভর বা আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনের অন্যতম ব্রত ছিল। ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে একটি জাতীয় আন্দোলন হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচির সূচনা করেন। গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা, মহকুমা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে স্বনির্ভর সমিতি গঠন করা হয়। স্বনির্ভর সমিতির তত্ত্বাবধানে গ্রামে বৃক্ষরোপণ, মাছ ও হাঁস-মুরগি পালনের খামার তৈরি হয়।
জিয়ার স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচির আরেকটি সাহসী পদক্ষেপ ছিল ‘গ্রাম সরকার’ ব্যবস্থা। গ্রাম সরকারের ক্ষমতা ও কর্মকাণ্ডের পরিধির মধ্যে অন্যতম ছিল খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারি নীতি কর্মসূচি বাস্তবায়নে কৃষকদের সহায়তা ও সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তদারকি। বস্তুত রাষ্ট্রপতি জিয়ার এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হওয়ায় কৃষক ও গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নতি ঘটে। জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন, গ্রামবাংলার উন্নতির ওপরই নির্ভর করে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এ জন্যই তিনি তার স্বল্পকালীন শাসনামলে গ্রামীণ কৃষি ও কৃষক সমাজে উন্নতির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। এ দেশের কৃষক সমাজ তাকে গ্রহণ করেছিলেন তাদের বন্ধু ও একান্ত স্বজন হিসেবে। বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও কৃষি সাংবাদিক শাইখ সিরাজ ১৯৯৫ সালে বিটিভিতে প্রচারিত ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে কৃষি ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ‘কৃষকপিতা’ উপাধি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
মৎস্য খাতের উন্নয়নে ভূমিকা: তিনি মৎস্য ও কৃষিকে একসাথে জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৭৯ সালে শুরু করেন জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ, যা আজও পালন করা হয়। এর মাধ্যমে দেশব্যাপী মাছ চাষে সচেতনতা ও আগ্রহ তৈরি হয়। মৎস্যচাষিদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা নিশ্চিত করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারি স্থাপনের ফলে পোনা উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা আসে। মৎস্যজীবীদের সমবায় সংগঠন গঠন করে বিপণন ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হয়। মাছ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণ করা হয়। জিয়াউর রহমান হাজা-মজা পুকুর ও জলাশয় সংস্কার করে এতে পরিকল্পিত উপায়ে মাছ চাষের ব্যবস্থা করেন। দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনায় খননকৃত খালে মাছচাষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। মৎস্য খাতের উন্নয়নে বিশেষ করে চিংড়ি চাষ ও চিংড়ি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
প্রাণিসম্পদ খাতে ঐতিহাসিক অবদানঃ শহীদ জিয়ার শাসনামলে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, টিকা কর্মসূচি এবং পশুচিকিৎসা সেবা জোরদার, পশু খামার প্রতিষ্ঠা ও পশুখাদ্য উৎপাদন কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। হাঁস-মুরগি খামার সম্প্রসারণ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। “দুধভিত্তিক অর্থনীতি” গড়ে তুলতে বিভিন্ন গ্রামে দুগ্ধ সমবায় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পদক্ষেপগুলোর ফলে মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশে বিপ্লব ঘটে।
ব্লু ইকোনমির সূচনা- সমুদ্র অর্থনীতির পথিকৃৎ জিয়াঃ ১৯৮১ সালে তিনি “সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি” গঠন করেন। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আহরণ ও সামুদ্রিক গবেষণায় দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করেন। ‘হিজবুল বাহার’ জাহাজে বঙ্গোপসাগরে নিজে সফর করে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন যা বাংলাদেশের Blue Economy চিন্তার সূচনা। তাঁর দৃষ্টিতে সমুদ্র ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির নতুন সীমানা— মৎস্য সম্পদ, জ্বালানি, খনিজ, নৌবাণিজ্য ও পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভাবনার আধার।
সবুজ বিপ্লবের সাফল্য ও উত্তরাধিকারঃ জিয়াউর রহমানের কৃষিনীতির ফলেই-খাদ্যশস্যে রেকর্ড উৎপাদন ঘটে, কৃষকের আয় ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে, দারিদ্র্য হ্রাস পায়, গ্রামীণ অর্থনীতি স্থিতিশীল হয় এবং বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি মাঠে নেমে কৃষকের সঙ্গে কাজ করেছেন- কখনো লাঙল হাতে, কখনো কোদাল হাতে। এই প্রতীকী নেতৃত্ব তাঁকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে চিরদিনের “কৃষকের বন্ধু” করে রেখেছে।
উপসংহার: সবুজ বিপ্লবের মহানায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কেবল মুক্তিযোদ্ধা বা রাষ্ট্রনায়ক নন- তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সবুজ বিপ্লবের স্থপতি। তাঁর কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, ব্লু ইকোনমি ও পল্লী উন্নয়ন নীতি বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও আত্মনির্ভরতার ভিত্তি স্থাপন করে। আজ আমরা যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশের কথা বলি, তার বীজ বপন করেছিলেন তিনি নিজ হাতে-খালের মাটিতে কোদাল চালিয়ে, কৃষকের পাশে দাঁড়িয়ে। ইতিহাস তাই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করবে- বাংলাদেশের সবুজ বিপ্লবের মহানায়ক হিসেবে।
-লেখক: , সাধারন সম্পাদক, এগ্রিকালচারিস্টস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- এ্যাব ঢাকা জেলা চ্যাপ্টার, সাংগঠনিক সম্পাদক, ভেটেরিনারি ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ভ্যাব।।