পতিত জমিকে সম্পদে পরিণত করতে পারে রোজেল উদ্ভিদ

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

বাকৃবি প্রতিনিধি: রোজেল, যা চুকোর বা টক গাছ নামে পরিচিত, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সত্যিকারের নতুন একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে। বীজ বপনের প্রায় ২২০ দিন পর একটি গাছ থেকে গড়ে ৫শ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত কাঁচা ফল পাওয়া যায়। তার সঙ্গে দেড়শ থেকে ৪শ গ্রাম পর্যন্ত বৃতির ফলন মেলে। হেক্টরপ্রতি মোট ফলন দাঁড়ায় তিন থেকে সাত টন। এই ফল ও মাংসল বৃতি দিয়ে জ্যাম, জেলি, চা, আচার, চাটনি, জুসসহ নানা ধরনের খাদ্য ও পানীয় তৈরি করা সম্ভব। রান্নাতেও ব্যবহার করা যায়।

শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে রোজেল নিয়ে আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে এসব তথ্য তুলে ধরেন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং "রোজেল উদ্ভিদের পাতা ও বৃতি উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের কলা-কৌশল" প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকির।

তিনি রোজেলের চাষ পদ্ধতি, উৎপাদন, খাদ্যমান, ঔষধি গুণ, এমনকি পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহারের দিকগুলোও ব্যাখ্যা করেন। অধ্যাপক জানান, পতিত জমিতে রোজেল চাষ করা যায়। দেশে এই উদ্ভিদ বাণিজ্যিকভাবে এখনো খুব পরিচিত নয়। আমার লক্ষ্য যেন কোনো জমি পতিত না থাকে। সে কারণেই বহু বছর ধরে অপ্রচলিত কিন্তু পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এমন উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করে আসছি।

তাঁর ভাষায়, রোজেল স্বাদেও অনন্য, গুণেও সমৃদ্ধ। বাড়ির উঠান বা রোদ-আংশিক ছায়াযুক্ত উঁচু জায়গায় চার-পাঁচটি রোজেল গাছ থাকলেই একটি পরিবারের দৈনন্দিন চা, জ্যাম বা আচার তৈরির চাহিদা সহজে মেটানো সম্ভব। পাশাপাশি রোজেলভিত্তিক খাদ্য ও পানীয় নিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতেও ভালো সুযোগ রয়েছে।

পুষ্টিগুণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোজেলের দুই ধরনের জাত আছে - লাল ও সবুজ। লাল রোজেলে অ্যান্থোসায়ানিন, ফ্লাভনয়েড, ক্যারোটিনসহ নানা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি পাওয়া যায়। এগুলো উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বেশ কিছু রোগ কমাতে সাহায্য করে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। শুকনা পাতা ও বৃতিতে প্রোটিন, চর্বি, ফাইবার ও মিনারেল পাওয়া যায়। রোজেল বৃতিতে প্রতি লিটারে ৩ থেকে ৪ গ্রাম টোটাল অরগানিক এসিড থাকে, যা এর বিশেষ টক স্বাদের উৎস। শুকনা পাতায় ছত্রাক বা জীবাণু তেমন আক্রমণ করতে না পারায় এটি সংরক্ষণেও সুবিধা হয়। যেহেতু এটি পুরোপুরি প্রাকৃতিক খাদ্যউপাদান, সেবনের নির্দিষ্ট মাত্রা নেই এবং উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায় না।

অন্যান্য ব্যবহারের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, রোজেলের কান্ড ও শাখা থেকে পাটের মতো আঁশ পাওয়া যায়। পরিপক্ব রোজেল বীজে প্রায় ২০ শতাংশ আমিষ এবং ২০ শতাংশ চর্বি থাকে, যা প্রক্রিয়াজাত করে পশুখাদ্য হিসেবে অনেক দেশে ব্যবহার করা হয়। জমির বেড়া হিসেবেও এটি কার্যকর, আর কর্তনের পর উদ্ভিজ্জ বায়োমাস খড়ি হিসেবে কাজে লাগে। লাল-সবুজ উভয় রঙের গাছই শোভাবর্ধক।

তিনি আরও বলেন, লাল রোজেলের বৃতির রঙ প্রাকৃতিক খাদ্য রঙ হিসেবে রপ্তানি করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে এর ভালো চাহিদা রয়েছে। বাণিজ্যিক চাষ হলে রপ্তানি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।

চা নিয়ে করা এক পরীক্ষার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ১:৪, ১:৩ আর ১:২ অনুপাতে রোজেল চায়ের সাথে মেশানো হয়েছিল। কিন্তু সার্ভেতে অংশ নেয়া প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ শুধু রোজেলই বেশি পছন্দ করেছে।

গবেষণায় সহায়তাকারীদের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, আমার স্ত্রী রাকেয়া তৌফিকা নাজনীন রেসিপি তৈরি ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সাহায্য করেছেন। পাশাপাশি বিভাগীয় অধ্যাপক ড. নেছার উদ্দীন, ড. আলমগীর হোসেন, ড. সবিবুল হক এবং উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দেলোয়ার হোসেনও যুক্ত ছিলেন।