আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি
নামসূত্র
বোকাইনগর। নামটি শুনে আপনার মনে হতেই পারে বোকা মানুষের নগর। আসলে কিন্তু তেমনটি নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক নাম। যেমনটি জানালেন মাকসুদুল হাসান। ময়মনসিংহ জেলার প্রায় প্রতিটি রেলস্টেশন সর্ম্পকেই তার বেশ জানাশোনা। তিনি একজন রেল কর্মকতা। দীর্ঘদিন ধরে বোকাই নগর রেল স্টেশনের পাশ্ববর্তী রেল স্টেশনগুলোতে কাজ করেছেন। তিনি জানান একাদশ ও চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময় এখানে কামরুপাধীন এক উপজাতি প্রধান অধিসামন্ত সর্দার 'বোকাই' কোচের রাজধানী ছিলো। বোকাইনগর নামের সাথে শাসকের স্মৃতি বিজরিত। এভাবেই নগরটির নাম হয় বোকাইনগর।
জানা যায় ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে নগরটি হোসেন শাহ এর নিয়ন্ত্রণে আসে এবং তিনি তাঁর পুত্র নুসরত শাহকে এর অধিকর্তা নিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে উসমান খান আফগান মুগলদের কাছে পরাজিত হয়ে উড়িষ্যা থেকে পালিয়ে ঈশা খান এর আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং বোকাইনগরের সামন্তরাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি নগরের বিভিন্ন দুর্গ পুনঃনির্মাণ করে এটিকে একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এখান থেকে মোঘলদের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করেন এবং দুর্গটি মোঘলদের অধিকারে চলে আসে।
অবস্থান
ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি পূর্বে গৌরিপুর উপজেলায় রয়েছে এই নগর। এখানে বোকাইনগর নামে একটি রেলস্টেশনও রয়েছে। রেলষ্টেশনটির বয়স প্রায় একশত বছর ছাড়িয়েছে। ১৯১৭ সনে স্থাপিত হয় বোকাই নগর রেলষ্টেশন। চাঁদ রায় বোকাইনগর রেল ষ্টেশনের কাছে একটি সেতুও নির্মাণ করেন। সেতুটি কালক্রমে মাটির নীচে চলে গেছে বলে এলাকাবাসী জেনেছেন ।
ইতিহাস
রেল স্টেশনের বয়োজেষ্ঠ্য আবদুর রউফ জানান, বাংলার নৃপতি ফিরোজশাহ আন্দিলের ভাতিজা সেনাপতি মজলিশ খাঁ হুমায়ূন ১৪৮৭-১৪৯১ খিস্টাব্দের মধ্যেবর্তী সময় উওর ও পূর্ব ময়মনসিংহ সামরিক অভিযান চালান। সে সময় তিনি বোকাইনগর দখল করেন এবং সেখানে একটি দূর্গ বা কেল্লা নির্মাণ করেন। বর্তমানে কেল্লাটির আর অস্থিত্ব নেই। কেল্লাটি যেখানে ছিলো এর অদূরে একটি তোরনসহ মাজার রয়েছে। এটি নিজামশাহ পীরের মাজার। নবাব আলীবর্দী খানের সময় বোকাইনগর এর পশ্চিম প্রান্তে বরেন্দ্র জমিদারদের কোন এক পূর্ব পুরুষ এসে বসতবাড়ী স্থাপন করেন। এসবের কোন কিছুই এখন নেই। তবে জমিদার বাড়ীর কিছু ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে। মুগল শাসকগন বোকাইনগর থেকে আশেপাশের অঞ্চলের শাসন করতেন। বোকাইনগর কেল্লা বর্তমানে নেই। বালুয়া নদীর একটি শাখার উওরে ও দক্ষিন পাশে কেল্লাটি মাটির দেওয়ালে বেষ্টিত ছিলো। এসবের কোন কিছুই এখন নেই। জমিদার বাড়ীর কিছু ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে।
কেল্লা বোকাইনগর
সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে তৎকালীন বাংলার সুবেদার খাজা উসমান গণি এই কেল্লাটি নির্মাণ করেন। তিনি এই কেল্লার সাথে একটি মসজিদ নির্মাণ ও একটি পুকুর খনন করেন। পরবর্তী সুবেদার চাঁদ রায় এই কেল্লার সাথে আরও একটি পুকুর খনন করেন এবং একটি মন্দির নির্মাণ করেন। মসজিদ, মন্দির ও কেল্লার ধ্বংসাবশেষ এখনও বর্তমান আছে। পুকুর দুটো ভরাট হয়ে গেছে এতে এখন ফসলের চাষাবাদ করা হয়। চাঁদ রায় বোকাইনগর রেল ষ্টেশনের কাছে একটি সেতুও নির্মাণ করেন। সেতুটি কালক্রমে মাটির নীচে চলে গেছে।
শাহী মসজিদ
কেল্লা বোকাইনগরে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারের পশ্চিম চামারখালি নদীর মোহনায় ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদ রয়েছে। এর নাম শাহী মসজিদ। প্রায় ৩ শত ১৮ বছর (বাংলা ১১০৫ সনে) আগে মোগল আমলে নির্মিত হয় প্রাচীন এই মসজিদটি। অনেকের মতে এর নির্মাণ করেন মজলিস খাঁ হুমায়ূন। আবার অনেকের মতে খাজা ওসমান খাঁ। মোঘল স্থাপত্য রীতি অনুসারে মসজিদটি নির্মিত হয়। চুন সুরকি ও বর্গাকৃতি কয়েক রঙের মূল্যবান পাতলা ইট দিয়ে তৈরি করা হয় মসজিদটি। প্রায় আড়াই হাত পুরো একটি মাত্র গম্ভুজের উপর নির্মিত হয় মসজিদ টি। বর্তমানে মসজিদের গম্ভুজটি নেই। ভাঙাগড়ার কারনে এর সৌন্দর্যহানি হয়েছে অনেক। তবে সামনের অংশ সেই মোঘল যুগের দেয়াল অবশিষ্ট আছে।
যেভাবে যাবেন
সড়ক পথে- ঢাকা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পথে ময়মনসিংহ সদর (প্রায় ১২০কি.মি.) হয়ে ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক পথে কলতা পাড়া হয়ে (প্রায় ২০ কি.মি.) দূরে গৌরীপুর উপজেলা পরিষদ। গৌরিপুরের ভিতরই এ রেলস্টেশন সংলগ্ন এ নগর।
রেলপথে- ঢাকা থেকে ঢাকা-ভৈরব কিশোরগঞ্জ হয়ে (প্রায় ২২০ কি.মি.) দূরে এবং ঢাকা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ হয়ে (প্রায় ১৫০ কি.মি.) দূরে গৌরীপুর উপজেলা পরিষদ।
ছবি: তারিফুল ইসলাম রুমন, গৌরিপুর, ময়মনসিংহ।