কৃষি নির্ভরতাই একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান অন্তরায়

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

প্রফেসর ড. খান মো: সাইফুল ইসলাম: "খাদ্য উৎপাদন করে দেশের মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব"- কথাটি সঠিক নয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, খাদ্যের পর্যাপ্ততা, মানসম্মত ও নিরাপদ খাদ্য এবং টেকসই ও পরিবেশবান্ধবতা নিশ্চিত না করে কেবল খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করলেই দেশকে খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে এগিয়ে নেয়া যায় না। কারন খাদ্য নিরাপত্তার এ সকল সূচক অন্যান্য বিষয় দ্বারা প্রভাবিত।

একজন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নির্ভর করে তার আয়ের উপর। তাই দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লে সে তার পরিবারের সদস্যদের জন্য সাধ্যমত খাদ্য ক্রয় করতে পারবে। কিন্তু কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত একজন মানুষের মাথপিছু আয় অন্যদের তুলনায় অনেক কম তাই খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে প্রথমেই যে বিষয়টি বিবেচ্য তাতে কৃষি, কৃষক এবং কৃষি নির্ভর ব্যাক্তিগনই পিছিয়ে থাকে অর্থাৎ তার ক্রয়ক্ষমতা কম থাকে। তাই সামষ্টিকভাবে কৃষিনির্ভর মানুষ তথা কৃষিনির্ভর দেশ খাদ্যনিরাপত্তায় পিছিয়ে থাকে।

খাদ্য নিরাপত্তা সূচক নির্ধারনীর পরবর্তী বিষয় হচ্ছে খাদ্যের পর্যাপ্ততা। যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করলেও একটি দেশের খাদ্যের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা সহজ নয়। কারন কৃষি নির্ভর একটি দেশের অধিকাংশ মানুষই কৃষক বা কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত, ফলে তার মাথাপিছু আয় অন্যদের তুলনায় কম। ফলে তার ক্রয়ক্ষমতা কম থাকার কারণে বেশী মূল্য পাবার আশায় দেশে উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সুতরাং রপ্তানি জনিত কারণে দেশে খাদ্যের পর্যাপ্ততা কমে যায়। এমতাবস্থায় এটি স্পষ্ট যে কৃষি নির্ভর দেশ খাদ্য উৎপাদন করে থাকলেও ক্রয়ক্ষমতা কম থাকার কারণে বিদেশে রপ্তানি করে খাদ্যের অপর্যাপ্ততা সৃষ্টি হয় এবং মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার সূচকে পিছিয়ে থাকে।

মানসম্মত খাদ্য উৎপাদনের ফলে খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যেহেতু কৃষি নির্ভর দেশের জনসাধারনের মাথাপিছু আয় কম সেহেতু মানসম্মত খাদ্য ক্রয় করা তাদের পক্ষে কঠিন অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তায় ৩য় যে শর্ত তা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ঠিক একই ভাবে কৃষিনির্ভর দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম থাকার এবং মানসম্মত খাদ্যের মূল্য বেশী থাকার কারনে দেশে উৎপাদিত খাদ্য বিদেশে রপ্তানী হয় যা অপর্যাপ্ততা সৃষ্টি করে অর্থাৎ কৃষি নির্ভর দেশের মানুষের মানসম্মত খাবার গ্রহনের মাত্রাও কমে যায়। অর্থাৎ কৃষি নির্ভর দেশ খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে পিছিয়ে থাকে।

নিরাপদ খাদ্য গ্রহণও খাদ্য নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। যেহেতু কৃষি নির্ভর দেশের জনগনের মাথাপিছু আয় কম সেহেতু অধিকাংশ সময়ে খাদ্য সামগ্রী ক্রয়সীমার বাহিরে থাকে। তবে যাতে ক্রয়সীমার মধ্যে আনতে পারে এবং প্রতিযোগীতামূলক মূল্যে বিক্রয় করতে পারে সেই কারণে খাদ্য উৎপাদনকারীরা খাদ্যে বিভিন্ন ধরনেরঅপকৌশল প্রয়োগ করে থাকে। ফলে ভোক্তা কম মূল্যে ক্রয়সীমার মধ্যে খাদ্য ক্রয় করতে পারে এবং বিক্রেতাও লাভবান হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিক্রেতার মাথাপিছু আয়ও তাকে খাদ্য অনিরাপত্তায় ভোগায়। শুধু তাই নয়, যদি উৎপাদনকারী নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে চায় তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই উৎপাদন মূল্য বেশী হবে যা ভোক্তার ক্রয়সীমার বাইরে থাকবে। ফলে লক্ষ করা যায় যে উৎপাদনকারীগণ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের কারণ হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশে রপ্তানীকেই অগ্রাধীকার দিয়ে থাকেন। যার কারনে নিরাপদ খাদ্য মূলত বিদেশে চলে যায়। তার ধারাবাহিকতায় দেশে খাদ্যের অপর্যাপ্ততা সৃষ্টি হয়, এবং মূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। সুতরাং কৃষি নির্ভর দেশের জনগনের মাথাপিছু আয় কম থাকার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা সূচকের সকল শর্তপূরণ কঠিন হয়।

যেহেতু উপরোক্ত কারনসমূহে কৃষি নির্ভর দেশসমূহ খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকে সেহেতু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ক্রমাগত চাপ অনুভব করে। তাই খাদ্য উৎপাদন অধিক মাত্রায় বৃদ্ধির কারনে বিভিন্ন কৌশল গ্রহনের ফলে কৃষিজ কর্মকান্ড পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। তাই পূনরায় ঝুঁকি কাটানোর জন্য কৃষি নির্ভর দেশটির অনেক ব্যবস্থা গ্রহন করতে হয়। তাই পরিবেশবান্ধবতা বৃদ্ধির জন্য অনেক অর্থ ব্যয় হয় যা মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে দেশটিতে অর্থসংকট সৃষ্টি হয়। ফলে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

 খাদ্য নিরাপত্তার সকল শর্তসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, কৃষি নির্ভর একটি দেশ খাদ্য উৎপাদন করলেও খাদ্য নিরাপত্তায় সকল শর্তসমূহ পুরণে প্রতিকুলতা সৃষ্টি   হয় যা বিশ্বায়নের কারণে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। একটি সমীক্ষায় ১১৩টি দেশের জিডিপি বিন্যাস পর্যবেক্ষন করে করে দেখা যায় যে, যে সকল দেশের জিডিপি কৃষিতে   বেশী সে সকল দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সূচক অনেক কম। অর্থাৎ কৃষিনির্ভর দেশের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তায় পিছিয়ে।

 তবে প্রশ্ন হচ্ছে কৃষি নির্ভর দেশ সমূহ কি কৃষি নির্ভরতা কমিয়ে দিবে। উত্তর হচ্ছে “না”। তবে ঐ সকল দেশসমূহকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষি শিল্পায়ন এমন কি কৃষিজ   দ্রব্য সমূহ উন্নত সেবার জন্য ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হবে। অর্থাৎ কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে কৃষি শিল্প ও কৃষিসেবা বৃদ্ধি করতে হবে।

 - লেখক: পশু পুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ