কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন: ব্রি উদ্ভাবিত বোরো মওসুমের নতুন হাইব্রিড ধানের জাত ব্রি হাইব্রিড ধান৮ প্রথম বছরেই সারাদেশে ফলনে কৃষকের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। চলতি বোরো মওসুমে হাইব্রিড ধানের ফলনের ধারনা বদলে দিয়েছে এই জাতটি। কৃষকরা বলছেন এই জাত ফলনের দিক থেকে বাজিমাত করেছে। সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া গেছে কুমিল্লার দেবীদ্বারে ১২.৭ টন/হেক্টর যেখানে ব্রি’র বিজ্ঞানী, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিএডিসির প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কয়েকবার ফলন যাচাই করা হয়। ব্রি হাইব্রিড ধান৮ স্বল্প মেয়াদী ও অধিক ফলনশীল হাইব্রিড ধানের জাত। এই জাতটি ২০২২ সালে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুর অঞ্চলে কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ড এর ১০৮তম সভায় অবমুক্ত হয়।
বাংলাদেশ সরকার কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য ১৯৯৮-২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৩৮টি হাইব্রিড ধানের জাত বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীর মাধ্যমে জাত হিসাবে অবমুক্ত করেছে । এসব জাতগুলির ৬২% চীন, ২৭% ইন্ডিয়া ও ১১% বাংলাদেশ থেকে উদ্ভাবিত। মওসুম হিসাবে ধরলে বোরো মওসুমের জন্য ২০২টি, আমন মওসুমের জন্য ২৯টি এবং আউশ মওসুমের জন্য ৭টি হাইব্রিড ধানের জাত কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ফলনের দিক থেকে সেরা জাত ব্রি হাইব্রিড ধান৮। প্রতি হেক্টরে জাতটির গড় ফলন ১০.৫-১১.০ টন। এই জাতের গাছের গড় উচ্চতা ১১০-১১৫ সে. মি। কান্ড শক্ত বিধায় গাছ ঢলে পড়েনা। স্বাভাবিক অবস্থায় গাছ প্রতি গুছির সংখ্যা ১০-১২ টি। ব্রি হাইব্রিড ধান৮ এর জীবনকাল ১৪৫-১৪৮ দিন। ধানের আকৃতি লম্বা চিকন। ১০০০ টি পুষ্ট ধানের ওজন ২৪.৩ গ্রাম। ধানে অ্যামাইলোজ ও প্রোটিনের শতকরা পরিমাণ যথাক্রমে ২৩.৩ ও ৯.২ ভাগ।
ব্রি আঞ্চলিক কার্যালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে বাস্তবায়িত ফলাফল পরিদর্শন ট্রায়ালে কৃষকের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ব্রি হাইব্রিড ধান৮। কুমিল্লা, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, হবিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সোনাগাজী, কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাট জেলায় স্থাপিত ফলন পরীক্ষার গড় ফলন ১০ টনের উপরে পাওয়া গেছে। ব্রি’র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর স্যারের উপস্থিতিতে সাতক্ষীরার তালায় এক ক্রপকাট অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ফলন পাওয়া গেছে ১২ টন/হেক্টর। কৃষক বলছেন এত ফলন আগে কখনও দেখেনি তারা এবং উপস্থিত সকল কৃষক আগামীতে ব্রি হাইব্রিড ধান৮ করতে প্রচন্ড আগ্রহ প্রকাশ করেন।
কৃষক পর্যায়ে ফলন ও অন্যান্য যে কারণে ব্রি হাইব্রিড ধান৮ করতে উৎসাহী তা হলো-আশাতীত ফলন, দানা চিকন ও আর্কষনীয় সোনালী বর্ণের, গাছ খাটো ও শক্ত তাই ঢলে পড়ার সম্ভাবনা কম, ডিগপাতা খাড়া ও পাকা অবস্থায় সবুজ থাকে, জীবনকাল অন্য হাইব্রিড জাতের তুলনায় কম (১৪৪-১৪৭ দিন), রোগ- পোকামাকড়ের আক্রমণ কম এবং এটি খরা সহনশীল জাত।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গোপালগঞ্জ আঞ্চলিক প্রধান ও সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম জানান, চলতি বোরো মৌসুমে গোপালগঞ্জ জেলায় ২০ হেক্টর জমিতে ৫০টি প্রদর্শনী প্লটে ব্রি হাইব্রিড ৮ ধানের আবাদ করেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষক ও ব্রি পরিসংখ্যান বিভাগের কর্মকর্তার উপস্থিতিতেই প্রদর্শনী প্লট থেকে ধান কেটে মাড়াই ও পরিমাপ করা হয়। সেখানে হেক্টরপ্রতি সাড়ে ১০ টন ফলন পাওয়া গেছে।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কুশলী গ্রামের কৃষক নাজমুল মোল্লা, রমজান সরদার, জাহাঙ্গীর গাজী, আরিফ গাজী ও মিজান মোল্লা বলেন, আমরা এর আগে হীরা হাইব্রিড ধান২, এসএল৮ সহ আরো অনেক জাতের হাইব্রিড ধানের আবাদ করেছি। ওইসব জাতে হেক্টরে ৮ থেকে সাড়ে ৮ টন ফলন পেয়েছি। কিন্তু ব্রি হাইব্রিড ৮ ধান চাষাবাদ করে শতাংশে ১ মণের বেশি ফলন পেয়েছি। সে হিসাবে হেক্টরে এই ধান সাড়ে ১০ টন ফলন দিয়েছে। এ ধানের চাল লম্বা। ওজনও বেশি। প্রতিটি ছড়ায় ধানের পরিমাণও বেশি পেয়েছি। জমিতে আগে এত ধান ফলেনি।
জানাগেছে, বাংলাদেশে প্রচলিত হাইব্রিড ধানের জাতগুলি তিনসারি পদ্ধতিতে উৎপন্ন হয়। এই তিনটি সারি হচ্ছে মাতৃ সারি বা পুংবন্ধ্যা সারি, উর্বরতা সংস্থাপক সারি ও পিতৃ সারি। হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপাদনের জন্য মাতৃ ও পিতৃসারি পাশপাশি লাগিয়ে কৃত্রিম পরাগায়নের মাধ্যমে হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপন্ন করা হয়। অধিকাংশ কোম্পানির হাতে উর্বরতা সংস্থাপক সারি না থাকায় প্রতিবছর বীজ উৎপাদনের সময় মাতৃসারি আমদানির প্রয়োজন হয়। চীন বা ভারত থেকে মাতৃসারি কিনতে কেজি প্রতি ২৫-৩৫ ডলারের প্রয়োজন হয়। তাই প্রতি বছর মাতৃসারি আমদানি করতে বিভিন্ন কোম্পানি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। এছাড়াও বাংলাদেশের বাজারে চীন উদ্ভাবিত যে সমস্ত অবমুক্ত হাইব্রিড ধানের জাত আছে সেক্ষেত্রে প্রতিটি অবমুক্ত জাতের জন্য কেজি প্রতি চাইনিজ কোম্পানীকে ৩৫-৫০ টাকা রোয়্যালটি প্রদান করতে হয়।
হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপাদনের জন্য যে ধরণের ফ্যাক্টর প্রয়োজন তা বোরো মওসুমে বিদ্যমান থাকায় শুধুমাত্র বোরো মওসুমেই বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপাদন করা যায়। বিগত কয়েক বছরে ফুল ফোটার সময় (এপ্রিল মাসের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত) তাপমাত্রা ৩৫০ সে. উপরে থাকায় পিতৃসারির ফুলের পরাগরেণু ও মাতৃসারির গর্ভাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া ডলার সংকটের কারণে সময়মত এলসি খুলতে না পারায় মাতৃসারি আমদানি ব্যহত হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে অবমুক্ত ২৩৮টি হাইব্রিড ধানের মধ্যে মাত্র ২৯টি হাইব্রিড ধানের উর্বরতা সংস্থাপক সারি (Maintainer or B Line) বাংলাদেশে বিদ্যমান যার মধ্যে ব্রি থেকে অবমুক্ত ৮টি হাইব্রিড ধানেরই উর্বরতা সংস্থাপক সারি ব্রি’র হাতে বিদ্যমান তাই চাহিদা অনুযায়ী মাতৃসারির বীজবর্ধন সহজেই করা সম্ভব।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন নতুন উদ্ভাবিত ব্রি হাইব্রিড ধান৮ আমদানিকৃত হাইব্রিড ধানগুলোর চেয়ে ফলন ও অন্যান্য গুনাগুণে উৎকৃষ্ট বিধায় বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে এবং আমদানি নির্ভর হাইব্রিড ধানের বাজারে ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হবে ।
লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।