"বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়" গৌরবোজ্জ্বল ৬৩ বছর ও অর্জন

কৃষিবিদ দীন মোহাম্মদ দীনু: কৃষি প্রধান এই দেশে সনাতন কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তে বিজ্ঞান-ভিত্তিক চাষাবাদের মাধ্যমে টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও কৃষি-বিজ্ঞান ভিত্তিক অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ষাটের দশকের গোড়ায় গড়ে ওঠা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশের প্রথম উচ্চতর কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার ঐতিহ্যবাহী জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আজ (১৮ আগস্ট ২০২৪) ৬৪তম বর্ষে পদার্পণ করছে। বিশ্বমানের গুণগত কৃষি শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ৬৩বছর যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিথযশা শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ নিরলসভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করে চলেছেন এবং ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে আতœপ্রকাশ করার সুযোগ লাভ করেছে।

এদেশের কৃষি বিপ্লব ও খাদ্য সয়ংস্পূর্ণতার লক্ষ্যে কৃষিশিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণের পথিকৃৎ বিদ্যাপীঠ হিসেবে ১৯৬১ সনে ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড.এম ওসমান গনি ১৯৬১ সালে প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বনিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জল যাত্রা শুরু করেন । ভেটেরিনারি ও কৃষি অনুষদ নামে দু’টি অনুষদ নিয়ে ১৯৬১ সনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই পশুপালন অনুষদ নামে তৃতীয় অনুষদের যাত্রা শুরু। এরপরে ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদ এবং ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ৬টি অনুষদ এবং ৩টি ইনস্টিটিউট এর আওতায় ৪৭টি শিক্ষা বিভাগ ও ৩টি ইনস্টিটিউট এর তত্ত¡াবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ এমন একটি পথিকৃৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা শিক্ষা, গবেষণা প্রশিক্ষণ ও স¤প্রসারণের মতো বহুমাত্রিক কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ও উচ্চতর কৃষি শিক্ষার আঁতুর ঘর হিসাবে সর্বজন স্বীকৃত। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জার্মপ্লাজম সেন্টার ও বাকৃবির সমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন আমাদের অন্যতম গৌরবের ও অহংকারের জায়গা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফরম্যান্স মূল্যায়নে সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের গ্লোবাল র‌্যাংকিং সিস্টেম চালু রয়েছে । সারা বিশ্ব জুড়ে মূলত টাইমস হায়ার এডুকেশন, কিউএস এবং সাংহাই এই তিনটি গেøাবাল র‌্যাকিং এর ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে। এ তিনটিতেই বাকৃবি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেছে,তা আমাদের জন্য গৌরবের। শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু পরিবেশে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের ধারায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আজ আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং এ বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে পরপর দুইবার প্রথমস্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফরম্যান্স মূল্যায়নের গ্লোবাল র‌্যাংকিং সিস্টেম এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ র‌্যাংকিং ‘সাংহাই র‌্যাংকিং’ এ ২০২২ সালের প্রকাশিত লাইফ সায়েন্স ক্যাটাগরির ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বারের মতো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দুইশ থেকে তিনশ,র মধ্যে তার অবস্থান নিশ্চিত করেছে। সাংহাই র‌্যাংকিং ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, এক্সিকিউটিভ, পলিসি মেকার কতৃক সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও সবচেয়ে প্রভাবশালী র‌্যাংকিং। সম্প্রতি সাংহাই র‌্যাংকিংয়ের ২০২২ সালের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের সম্মানিত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারিদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এই দুর্লভ সুনাম অর্জন সম্ভব হয়েছে ।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সিমেস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা দান করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে ইলসিভিয়ার এর ই-বুক এক্সেস,ডাউনলোড এবং প্লাজিয়ারিজম চেকার চালু করা হয়েছে। এতে ইলসিভিয়ার পাবলিশার কর্তৃক ৪১০০টি টাইটেল ই-বুক এর এক্সেস পাওয়া যাচ্ছে । এমএস ও পিএইচডি থিসিস প্লাজারিজম চেকারের মাধ্যমে চৌর্যবৃত্তির ঘটনা রোধে সক্রিয় রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা কমিটি এ উদ্যোগ গ্রহন করেছে, যার প্রেক্ষিতে এ বিশ^বিদ্যালয়ের সম্মান ও সুখ্যাতি বহু গুনে বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ভর্তিসহ সকল আর্থিক লেনদেন কার্যক্রম অনলাইনে অর্থাৎ ক্যাশ লেস সিস্টেমে চালু হয়েছে। এ কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্যে ছয়টি অনলাইন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ডিজিটাল লেনদেনের লক্ষ্যে দেশের অনলাইন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ, নগদ, উপায়, রকেট, পূবালী ও সোনালী ব্যাংকের সাথে চুক্তি সম্পাদন হয়েছে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন বিভাগ, শাখা, অফিস এবং হলে কর্মরত কর্মকর্তা, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সকল কর্মচারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সকল আর্থিক লেনদেন অনলাইনে অর্থাৎ ক্যাশ লেস লেনদেন করতে সক্ষম হবেন।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে বর্ণাঢ্য গবেষণা সাফল্য Ñ গবেষণা প্রকল্পসমূহ সুষ্ঠুভাবে সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার স্বার্থে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম (বাউরেস) এর তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে চার হাজারেরও বেশী গবেষণা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৬ শতাধীক গবেষণা প্রকল্প চালু রয়েছে, বাউরেস-এর প্রধান আর্থিক উৎস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট। অন্যান্য যে সকল উৎস থেকে গবেষণা-সহায়তা পেয়ে থাকে, তন্মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সায়েন্স অ্যান্ডটেকনোলজি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ফাউন্ডেশন, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিভাগ (ইউএসডিএ), যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ (ডিএফআইডি), সুইডিশ ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন, নরওয়েজিয়ান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (নোরাড) ডেনিডা, অর্গানাইজেশন ফর উইমেন ইন সায়েন্স ফর দ্যা ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড (ওডাবি¬উএসডি) অন্যতম।

উল্লেখ্য, বাউরেস-এর আর্থিক প্রশাসনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত আর্থিক বিধিমালা ও আইনকানুন অনুসরণ করা হয়ে থাকে। বাউরেস-এর পরিচালনাধীন বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে বহুসংখ্যক এম.এস ও পিএইচ.ডি পর্যায়ের শিক্ষার্থী গবেষণা কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনামধণ্য গবেষকবৃন্দ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ফসলের জাত, ফসল, মাৎস্য ও প্রাণিররোগ দমন পদ্ধতি, সঠিক প্রাণি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা মডেল,আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি,কৃষি অর্থনীতির বিভিন্ন মডেল,যুগোপযোগী মার্কেট চেইন, ভ্যাকসিন, জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ আজ খাদ্য নিরাপত্তায় ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সেই সাথে ক্রমাগতভাবে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ফল ও শাকসবজির উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত গতিতে। এ বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিভিন্ন ডিগ্রিপ্র্রাপ্ত কৃষিবিদগণ আজ ছড়িয়ে আছেন দেশের কৃষি ও গ্রামোন্নয়নে নিয়োজিত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। উত্তীর্ণ কৃষিবিজ্ঞানীদের অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পুরস্কৃত হয়েছেন এবং একই সাথে পেশাগত পূর্ণতায় বিকশিত হয়ে দেশের কৃষি-সংস্কৃতির পরিমন্ডলকে করেছেন সমৃদ্ধ ও আলোকিত। ফলে দেশ আজ ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে অসামান্য সাফল্য লাভ করতে পেরেছে। কৃষিক্ষেত্রে দৃশ্যমান এ সাফল্যগুলোর কৃতিত্ব এ দেশের কৃষক ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের, এটি আজ সর্বজন স্বীকৃত। বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সমস্যা ও চাহিদা মোকাবেলাসহ নানাবিধ জাতীয় চাহিদা মোকাবেলার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়কে সবসময় তৈরি থাকতে হয়।

কৃষির নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামগ্রিক উন্নয়নধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে আগামীতেআরও কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য সেশনজট মুক্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পরিচালিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত এক সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ বিণির্মানে এধারা অব্যাহত রাখতে আমরা সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

লেখক: উপ-পরিচালক ,জনসংযোগ ও প্রকাশনা দফতর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ