সমীরণ বিশ্বাস: বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে, জাতীয় সংসদে পেশ করা বাজেটে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি মোকাবেলা নিয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি। গত বাজেটে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে এক হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও এবারের বাজেটে তা কমিয়ে এক হাজার ২২১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, গত বাজেটের তুলনায় কমেছে ২৫ কোটি টাকা।
সরকার মোট উন্নয়ন বাজেটের ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে, ১১ দশমিক ৫ শতাংশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে, ১৫ দশমিক ১ শতাংশ স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে, ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে, ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষি খাতে, ৬ দশমিক ৬ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে, ৬ দশমিক ৪ শতাংশ জনপ্রশাসন খাতে ও ৩ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রতিবেশের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্যে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।
পরিবেশবাদীরা পরিবেশ রক্ষার জন্যে যা প্রয়োজন তা করার কথা বললেও সরকার সাধারণত তা উপেক্ষিত থাকেই গেছে। পানি ও বায়ু দূষণ বন্ধ এবং বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্যে বাজেটে উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। এক্ষেত্রে সরকারকে তেমন কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেবার ইঙ্গিত নাই । বাংলাদেশ এখন স্বল্প উন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে। উন্নত দেশগুলো এখন জানতে চাইবে, আমাদের পণ্যগুলো টেকসই পরিবেশে তৈরি হচ্ছে কি না।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। যেখানে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৭১ কোটি টাকা। বরাদ্দ বেড়েছে ৬০ কোটি টাকা। যা কোনভাবেই যথাপযুক্ত মনে করেন না পরিবেশবাদী এবং অংশীদারিগণ। বর্তমানে দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের যে করাল গ্রাস তান্ডব বহমান রয়েছে তাহা এই অপ্রতুল বাজেট দিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কোনমতেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ । যদিও কার্যক্রমকে আরও বেগবান করার লক্ষ্যে জলবায়ু খাতে ১০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এবারের বাজেট দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট। প্রস্তাবিত এ বাজেটের প্রতিপাদ্য সুখী-সমৃদ্ধ , উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার। এবারের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় এবারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় বিভাগে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, প্রায় ১৭ লাখ জনসংখ্যার বাংলাদেশে এ বরাদ্দ কতটুকু কাজে আসবে তা আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। মূলত ব্যাপক জনঘনত্ব ও ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ বাড়ছে, ফলে দেশব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরী হয়েছে।
যেকোনো অঞ্চলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাই সুস্থ ও নির্মল পরিবেশ। আমাদের সামগ্রিক জীবনের ওপর পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম। বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের অবক্ষয় সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত একটি বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, বন্যা, দুর্যোগ, বন উজাড়, নদীভাঙনের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী কোনো না কোনো অঞ্চল পরিবেশ বিপর্যের সম্মুখীন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে । ব্যাপক জনঘনত্ব ও ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ বাড়ছে, ফলে দেশব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেমন গাছপালা কর্তন, কৃষিকাজে অপরিকল্পিত, অযাচিত কীটনাশকের ব্যবহার, মাটি উত্তোলন ও পাহাড় কাটা, গভীর নলকূপের মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন, অতিরিক্ত সেচকাজ ইত্যাদি দেশের পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ভৌগোলিক অবস্থান, ভূপ্রকৃতি এবং কিছু প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদাপন্ন দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশের আবহাওয়া সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুত হারে তার স্বাভাবিক রূপ পরিবর্তন করছে এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ফলে বাড়ছে তাপমাত্রা। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের তাপমাত্রার সঙ্গে বর্তমান তাপমাত্রার তুলনা করলে দেখা যায়, গড়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি বেড়েছে।
প্রতিকূল এ পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে বিপর্যস্ত হচ্ছে স্বাভাবিক জনজীবন। নিয়মিত ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, সাম্প্রতিক তাপদাহ, বজ্রপাত, খরা ইত্যাদি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকট হচ্ছে পরিবেশগত হুমকি। এসব হুমকি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ। পবিবেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রকৃত পক্ষে অনেকগুলো সেক্টরকে সমন্বিত করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা মাফিক পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। কারণ পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান, যেমন বায়ু, পানি, মাটি, ও জীবমণ্ডল প্রতিটি একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং পরিবেশের সামগ্রিক সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, যেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দও পরিবেশ খাতের দিক বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় ছাড়াও পরিবেশ সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়েরও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় পানিসম্পদের যথাযথ ও সুচিন্তিত ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের পানিসম্পদের দক্ষ ও টেকসই ব্যবস্থার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প, যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীভাঙন রোধ, ড্রেজিং, সেচ ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও ভূমি পুনরুদ্ধার ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্প যথাযথ অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে চলমান রাখা অতীব জরুরী।
বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন। কারণ: দূষণ, দখল, দুর্যোগ, দাবানল, শিকার ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির সম্মুখীন। সুন্দরবনসহ সারা দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ, যেমন: বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, দাবদাহ ইত্যাদির প্রকোপ বেড়ে চলেছে। সেজন্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলায় বাজেটে আরো অতিরিক্ত অর্থ বাড়ালে এসব দুর্যোগে আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ ও সম্পদহানির কিছুটা উপকৃত হবে। মূলকথা পরিবেশ সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়নে সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাজেট বরাদ্দ সময়ের দাবি। বাজেটে উপেক্ষিত থাকবে না পরিবেশ, বিশেষ গুরুত্ব পাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং দুর্যোগ প্রশমন এই আশাই সুধীজনদের ।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।