জলাবদ্ধতার শেষ কোথায় ?

সমীরণ বিশ্বাস: অগভীর ও বহু আগের ড্রেন ব্যবস্থা, বন্যা ও বৃষ্টির পলিমাটি, উন্মুক্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ড্রেনে ময়লা- আবর্জনা ফেলা, অসম্পূর্ণ পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা, অপরিকল্পিত পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বিদ্যমান পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং বর্জ্য নিষ্কাশনের পথগুলোতে ময়লা আবর্জনার স্তুপ অপসারণ না করা ইত্যাদি ঢাকা সহ সারাদেশে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ।

সামান্য বৃষ্টি হলেই ,অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ অন্যান্য বড় বড় মেট্রোপলিটন শহর ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে জলাবদ্ধতার সমস্যা। সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের শহরে জলাবদ্ধতার সমস্য প্রকট আকার ধারণ করে। ইদানিং ঢাকাবাসি আরো মারাত্মকভাবে জলাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়ে হচ্ছেন। সামান্য বা অবিরাম বৃষ্টিপাতে রাজধানীর বিভিন্ন অংশ ও প্রধান সড়ক গুলোর ডুবে একাকার হয়ে যায়। রাজধানীর বৃষ্টির পানি ওয়াসার খাল ওয়াসার খাল- নর্দমা দিয়ে নদীতে পৌঁছানোর কথা কিন্তু নর্দমার পানি মাথাপ্রাপ্ত হচ্ছে। অন্যদিকে খাল গুলো অবৈধভাবে ভরাট করে দখল করা হয়েছে। তাই সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা এখন ঢাকা বাসির নিত্যদিনের সাথী ।

ঢাকার জনসংখ্যা দিন দিন প্রচন্ডভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই অপরিকল্পিত,অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, জনস্বার্থে বিষয়গুলি মোকাবেলা করতে পারছেন না। ফলে জলাবদ্ধতার মত সমস্যা জনজীবনকে বিষিয়ে তুলছে। বর্তমান সময়ের বছরগুলোতে ঢাকা শহরে বর্ষার সময়, মে থেকে অক্টোবর পানি দূষণ, যানজট, বায়ু ও শব্দদূষণ, বর্জ্যনিষ্কাশন, কালোধোয়া ইত্যাদির মত জলাবদ্ধতাও নিয়মিত বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শহরে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হলেই; ঢাকা শহরে বিভিন্ন এলাকার রাস্তা জলাবদ্ধ হয়ে ডুবে থাকে। এই অবস্থার জন্য অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং অপরিকল্পিত পয়: নিষ্কাশন ব্যবস্থা দায়ী । এছাড়া ঢাকার মহানগরীর বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টজনেরা ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্লানার্স এর জরিপ মতে জানা গেছে, গত দশ বছরে ঢাকা মহানগর ও এর আশেপাশের কমপক্ষে ৩ হাজার ৪৮৩ একর জলাশয় এবং নিম্ন ভুমি ভরা হয়েছে। উক্ত জরিপে আরও বলা হয়েছে, নগরীর বিভিন্ন অংশে ১০ বছর আগে ১ লাখ ৯৩৭ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ছিল, কিন্তু ইতিমধ্যে এর মধ্যে ২২% অর্থাৎ ২২ হাজার ১৫৬ একর ভরাট করা হয়েছে, যা প্রতি বছর জলাবদ্ধতা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। জলবায়ু পরিবর্তন তথা বর্ষাকালে ঢাকা শহরে ইদানিং কালে ভারী বর্ষণ হয়। এটি কারণ, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বিস্তৃত প্লাবনভূমিতে এলাকাটির অবস্থান বিধায় আবহাওয়াবিদগণ মনে করেন। অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন কার্যক্রম এবং দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জলাধার গুলোতে অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে পারছেন না। এরই সাথে প্রাকৃতিক পয়: নিষ্কাশন পথগুলোতে নগরীর জল প্রবাহ সঠিকভাবে প্রবাহিত হতে না পারার কারণে, জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। যাহার কারণে প্রতিনিয়তই এখন বিভিন্ন এলাকা বেশ কয়েকদিন ধরে জলবদ্ধ হয়ে থাকায় এলাকাগুলি সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ছে । ড্রেন ব্যবস্থার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং মৌসুমী জোয়ারের প্রভাব এবং শহর অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থানও জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী।

ঢাকা মহানগরের পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানিরপাম্প, খাল এবং নদীগুলো মোট সাতটি বেসরকারি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ, রাজধানীর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রতিটি সংস্থা পৃথকভাবে কাজ করে, কিন্তু কারো সাথে কারো সমন্বয় ,পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও সহযোগিতা বিন্দুমাত্র চিহ্ন নাই। ঢাকা মহানগরের ড্রেন ও খাল গুলি অনিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নগরবাসীর সচেতনতার অভাবে ঢাকার বেশিরভাগ ড্রেনগুলো ভারী বর্জ্য এবং প্লাস্টিকের আবর্জনায় আবদ্ধ হয়ে আছে ।বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা ঢাকা-বাসীদের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। যাহা সামাজিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব তৈরি করে। রাস্তাঘাটে তৈরি হয় অসহনীয় যানজট। বসতবাড়ি ও অবকাঠামোর ক্ষতি করে গাছপালা এবং প্রাণীকুলের বাসস্থান ধ্বংস করে, শ্রমজীবী মানুষের আয়-রোজগারের ক্ষতি করে এবং মহানগরবাসীর জীবনে এই জলাবদ্ধতা নানাভাবে অভিশাপ হিসাবে দেখা দেয়। বৃষ্টির পানি জলাবদ্ধতার কারণে দূষিত হয়ে ভারী বর্জ্য, ক্লিনিক্যাল বর্জ্য, পলি, দুষক, গার্হস্থ্য বর্জ্য এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ মানবিক ক্রিয়া-কলাপের সাথে মিশ্রিত হয় যা পানিবাহিত রোগ গুলিতে বাড়িয়ে তোলে। এর থেকে তৈরি হয় দুর্গন্ধ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ।

দুঃখ হলেও সত্য যে, ঢাকা শহরে ৬৫ টি প্রাকৃতিক খাল ছিল, কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা আছে ২৬ টি মাত্র। তাদের বেশিরভাগই আবর্জনায় ভরপুর ও ভূমি দস্যুদের দখলে। ঢাকায় ১২% জলাধার থাকার কথা ছিল যা এখন আছে মাত্র ৩%। ইতিমধ্যে খালের সংযোগ গুলি বিভিন্ন রকমের অবৈধ অবকাঠামো দিয়ে অবরুদ্ধ করা হয়েছে । প্রাকৃতিক জলাশয় গুলি উদ্ধার করার জন্য কালবিলম্ব না করে সমস্ত খাল অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করে সংযোগ স্থাপন করতে হবে, যাতে শহর থেকে পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশিত হতে পারে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। আর একটি বড় সমস্যা হলো; বক্স কালভার্ট গুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নাই বললেই চলে- যার ফলে পানি খুব ধীর গতিতে প্রবাহিত হয়। বেশিরভাগ খালই এখন ওয়াসার নিয়ন্ত্রণে। বাকি খালগুলি নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। জলাবদ্ধতা ব্যবস্থাপনা বর্তমান সময়ে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জলাবদ্ধতা মোকাবেলার জন্য, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুর দক্ষতা বৃদ্ধি, পরিকল্পনা, সমন্বয় সাধন, এবং জনসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে। সেই সাথে বাড়াতে হবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা।

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।