ড. এম মনির উদ্দিনঃ ছোট আয়তনের বিশ্বের ৮ম জনবহুল বাংলাদেশে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এর সর্বশেষ শুমারী অনুযায়ী দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাস তবে অনেকেই জনসংখ্যা ১৮ কোটিও বলে থাকেন। যাই হোক, কৃষি প্রধান বাংলাদেশের প্রতিবছর আবাদি জমি কমছে অন্যদিকে মানুষ বাড়ছে প্রতিবছর ১.৩ শতাংশ হারে। এর ফলে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা এবং এই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর প্রধান বাধা হয়ে দাড়িয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তন।
উন্নত দেশগুলো তাদের ইচ্ছামত জীবাম্ম জ্বালানী ব্যবহারের মাধমে শিল্পায়নের জন্য গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমন বাড়িয়ে যাচ্ছে যার নেতিবাচক প্রভাবে ভুগছে আমাদের মতো গরীব দেশগুলো যাদের বিশ্বের গ্রীনহাউজ নির্গমনে তেমন কোন ভুমিকাই নেই। ইতিমধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারনে দেশের কৃষি উৎপাদন কমেছে ৭-১০ শতাংশ। দেশের বেশিরভাগ মানুষ যারা কৃষির সাথে জড়িত তারা প্রান্তিক কৃষক যাদের জলবায়ু সহনশীল কার্যকলাপে বিনিয়োগ করার জন্য অর্থ নেই। আর, এ জন্যই কৃষিতে আগামীদিনগুলোর জন্য প্রতিফলিত হচ্ছে এক অশনি সংকেত।
এ বছর রবি ফসল উঠানোর পর পরই কৃষকেরা মাঠে বর্ষাকালীন শাকসব্জি উৎপাদন শুরু করে এবং ফসল উঠানোর মাঝ পর্যায়ে ২৬ মে আঘাত হানে ঘুর্নিঝড় রেমাল যার ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারী বর্ষনজনিত কারনে শাকসব্জির ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং কৃষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে। এরপর, আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সারাদেশের কৃষকেরা আগাম শীতকালীন শাকসব্জি বাজারে তোলার জন্য উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। আমরা সকলেই কমবেশী অবগত যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারনে দেশে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। এর ফলে দেখা দিচ্ছে অসময়ে খরা, বৃষ্টি, অতি বৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এ রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে দেশের চলমান কৃষি।
দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষক উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, সেপ্টেম্বর মাস থেকে অদ্যাবধি দেশের সার্বিক আবহাওয়াগত অবস্থা কৃষির অনুকুলে না থাকায় সকল শাকসব্জি চাষকারী কৃষক একই জমিতে পর পর সর্ব্বোচ্চ ৫ বার পর্যন্ত সব্জি ফলানোর চেষ্টা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বিফল হয়েছেন। শুধুমাত্র বন্যা আর বৃষ্টিজনিত কারনে প্রতিটি ফসল লাগানোর পরই নষ্ট হয়ে যায়। অঞ্চলভেদে উচু এলাকার কৃষকেরা অনেক শ্রম, ঘাম আর ফসলের বিভিন্ন রোগের সাথে সংগ্রাম করে তাদের ফসল টিকিয়ে রাখতে পেরেছে যা বর্তমানে বাজারে বিক্রয় হচ্ছে। এখনো শাকসব্জি লাগিয়ে কৃষকেরা বিভিন্ন রোগের কারনে ফসল টিকাতে পারছেনা। মাঠে বর্তমানে যারা ফসল তুলছেন বা যারা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আবার লাগানো শুরু করছেন তাদের কেউ ভালো নেই। কারন একের পর এক ঔষধ কিনে স্প্রে করতে হচ্ছে ফসলকে রক্ষা করার জন্য।
আপনারা যদি দেশের বিভিন্ন এলাকার গ্রামগুলিতে যেয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে যে, অনেক ব্রয়লার বা লেয়ার মুরগীর খামার পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ১০-১৫ বছর আগে দেশের অনেক যুবক উদ্যোক্তা/খামারী অতি উৎসাহ নিয়ে কিছু পুঁজি হাতে নিয়ে গ্রামীন পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগী এবং লেয়ার মুরগীর খামার স্থাপন করেছিল এবং প্রথমদিকে বাজার ভালো পাওয়ায় তারা বেশ লাভবান হচ্ছিলো কিন্তু তা খুব বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। উৎপাদনকারীরা বাচ্চার দাম বাড়াতে থাকলো, খাদ্যের দাম বাড়াতে থাকলো, ঔষধপত্রের দাম বাড়লো, সরকারী অফিসের সেবা পেলোনা। এভাবে প্রথমদিকে কিছু লাভ করায় খামারীদের উৎসাহ বেড়ে যাওয়ায় তারা পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের মধ্যেও চড়া দামে সকল উপকরণ সংগ্রহ করেই লাভের আশায় খামারে রাত দিন শ্রম দেয় কিন্তু আর হিসাব মেলেনা, ব্রয়লার উৎপাদনে যে খরচ পড়ে সেই খরচ উঠেনা। একটি ডিম উৎপাদনে যে খরচ পড়ে তা বিক্রয় করে লাভ থাকেনা। কিন্তু, লটারির মতো আশায় বুক বেধে তারা কয়েক বছর খামার চালানোর পর আর পুঁজি খুজে পাওয়া যায়না এবং এই সকল উদ্যোক্তা/খামারীরা খামার ফেলে কেউবা অন্য পেশায় আবার কেউ সব হারিয়ে বেকার বসে আছে।
এই বিষয়টি যদি আপনি বিবেচনায় আনেন, কে দোষী? খামারী কেন কম দামে ব্রয়লার বা ডিম বিক্রয় করছে না? দেশের ছোট ছোট খামারীরা উচ্চমুল্যের সব উপকরণ কিনে, রোগবালাইয়ের আক্রমনে টিকতে পারছেনা। আর, এই সুযোগে ব্যবসা ইতিমধ্যে সিন্ডিকেটভুক্ত বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। প্রান্তিক খামারীরা টিকতে পারেনি বা পারছেনা কিন্তু দেশের এই প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ব্রয়লার উৎপাদন করছে, ডিম উৎপাদন করছে এবং বাজারও তারা নিয়ন্ত্রন করছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এর উদ্ভাবিত ধানের জাত যার বীজ দেশীয়ভাবে সংরক্ষন ও ব্যবহার করা যায়, সেই বীজ বর্তমানে বোরো মৌসুমে চাষের জন্য ২২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রয় হচ্ছে। কৃষক স্থানীয় ডিলারেদের কাছে গিয়ে ভালমানের পেস্টিসাইড পাচ্ছে না বরং ডিলার উচ্চ দামে একটি রোগের জন্য একাধিক পেস্টিসাইড ধরিয়ে দিচ্ছে। সরকারের অনেক মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা মাঠে থাকার কথা থাকলেও কৃষক পরামর্শের জন্য তাদের নাগাল কখনো পাচ্ছেনা। কিছু কিছু সচেতন কৃষক ফেসবুকে ফসলের ছবি দিয়ে অভিজ্ঞদের কাছে পরামর্শ চাচ্ছে যা অত্যন্ত উৎসাহজনক তবে সকল কৃষক এই সেবা নিতে পারছেনা। বীজে ভেজাল, সারে ভেজাল, পেস্টিসাইডে ভেজাল অথচ এগুলো কেউ দেখার নেই।
আমরা দেশের মানুষ যারা বর্তমানে কৃষি কাজের সাথে জড়িত নই, তবে আমাদের সকলেরই এই কৃষি পরিবার থেকে উঠে আসা। কারন, কৃষিকে ঘিরেই ছিলো এদেশের মানুষের বাঁচার এবং কাজের একমাত্র প্রধান উপায়। দেশে বর্তমানে কৃষি পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫২ লাখ এবং অকৃষি পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩৬ লাখ। একসময়, গ্রামের প্রতিটি বাড়ীর আঙ্গিনায় সারাবছর ধরে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের শাকসব্জি, মশলা ফসল বিশেষ করে কাঁচা মরিচ, আদা, হলুদ, রসুন, পিয়াজ থাকতোই। পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর পর হাট বাজারে নিয়ে বিক্রয় করা যেতো অতিরিক্ত শাকসব্জি ও মশলা। তবে, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পুর্বে গ্রামের হাট বাজার থেকে পাইকারেরা বিভিন্ন শাকসব্জি কিনে তা পাশ্ববর্তী শহরে নিয়ে বিক্রয় করতো। আর, এখন শহরের আড়ত থেকে পাইকার, ফড়িয়াগন শাকসব্জি কিনে নিয়ে তা গ্রামের হাট বাজারে বিক্রয় করে।
ইদানিং অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে শাকসব্জির চড়ামুল্য, কাঁচামরিচের অস্বাভাবিক দাম, শাকসব্জির অপ্রতুলতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লিখছেন যা আজকের অত্যন্ত বাস্তব চিত্র। তবে, আমরা সকলেই অবগত যে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসময়ে বন্যা, সেপ্টেম্বর মাস থেকে সারাদেশেই অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারনে কৃষক শাকসব্জি চাষ করতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। ভৌগলিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশের কোন কোন উচু অঞ্চলে কিছু শাকসব্জি উৎপাদিত হয়েছে যা চাহিদার তুলনায় কম এবং বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে তা চাহিদার প্রায় চার ভাগের একভাগও না। দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের যে অবস্থা, তাতে আগামীদিনে যে সফলভাবে সব মৌসুমে জমিতে ফসল ফলানো যাবে তাতে আশংকা রয়েছে। তাই আমরা যারা শুধু শাকসব্জি কিনে খাওয়ার উপর নির্ভরশীল তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে দেশের উৎপাদনে অংশগ্রহনের জন্য।
একটি সামান্য উদাহরন দিয়ে আমরা দেখি, দেশে ৩ কোটি পরিবার রয়েছে গ্রাম ও শহর মিলে যাদের অত্যন্ত ছোট থেকে বিভিন্ন আয়তনের বসতভিটা, বাসার আশেপাশে, ছাদ ইত্যাদি যেখানে প্রতিটি পরিবারে ২টি করে কাঁচা মরিচ গাছ লাগালে এবং এই ২টি গাছ থেকে মাত্র ২০০ গ্রাম কাঁচামরিচ সংগ্রহ করতে পারলে দেশের কাঁচামরিচ উৎপাদিত হবে ৬ হাজার টন। যদি প্রতিটি খানায় ২টি করে পেঁপে গাছ থাকে এবং বছরে ২টি গাছ থেকে ১০ কেজি পেঁপে পাওয়া যায়, দেশের মোট উৎপাদন বেড়ে যাবে ৩ লাখ টন। একইভাবে, প্রতি পরিবারে ১টি আঁদা চাষের বস্তা থাকলে এবং সর্বনি¤œ ৫০০ গ্রাম আঁদা পাওয়া গেলে দেশের উৎপাদনে যুক্ত হবে ১৫ হাজার টন আঁদা।
জমিতে ফসল ফলাতে গিয়ে একজন কৃষকের কত অর্থ, শ্রম, ঘাম যায় তা আমরা অনেকেই জানিনা। তবে, শংকার বিষয় হলো যে, কৃষক তার পরিশ্রমের কোন ফলাফল না পেয়ে অনেকেই আজ ক্লান্ত ও হতাশ। কারন, বিরুপ আবহাওয়ায় ফসল ফলাতে গিয়ে তারা ধীরে ধীরে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। আগামীদিনে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহন করতে না পারলে অনেক কৃষক পেশা বদল করতে বাধ্য হবে। একটি কথা অতিশয় সত্য যে, আমাদের পকেটে টাকা থাকবে কিন্তু টাকা দিয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যটি সময়ে নাও পেতে পারি। তাই, আগামীদিনে সকলের খাদ্যের নিরাপত্তায় সকলকেই কৃষক হতে হবে। পরিবারের কিছু না কিছু কৃষিপণ্য বিশেষ করে বর্ষাকালীন সময়ে যে সকল মশলা, সব্জি কম থাকে তা যতটুকু সম্ভব আমাদেরকে উৎপাদন করতেই হবে। কারন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারনে সামনের দিনের কৃষি আরো জটিল হবে, এটিই স্বাভাবিক আর কৃষক এর জন্য বিন্দুমাত্র দায়ী নয়।
বাংলার কৃষক ব্রিটিশদের দ্বারা শোষিত ও অত্যাচারিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষক শুরু থেকে অদ্যাবধি একইভাবে দেশীয় বিভিন্ন শোষক শ্রেনীর মাধ্যমে শোষিত হচ্ছে। দেশের কৃষি ও কৃষককে ঘিরে ব্যবসার নামে যে লুটপাট, ঘুষ, দুর্নীতি চলছে তা মনে হয় দেশের অন্য কোন সেক্টরে এতোটা ভয়াবহ অবস্থায় নেই। কৃষক, খামারীরা আজ সকল কৃষি উপকরণের খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে এবং সকল প্রতিকুলতার মাঝে আবদ্ধ হয়ে অনেকটাই নিঃস্ব। আমরা তাদেরকে এমনভাবে চুষতেছি যে, তাদের দেহে কোন রস আর নেই। আর কতোদিন এদেশের খাবার উৎপাদনকারী এই কৃষক শোষিত হবে? তারপরও কৃষক বসে নেই। নিজের পরিবারের প্রয়োজন চিন্তা না করে তার গবাদিপশুর খাবার যে কোনভাবেই ক্রয় করছে, কৃষি উপকরণ ক্রয় করে জমিতে ফসল ফলানোর জন্য অব্যাহতভাবে কষ্ট আর সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও কৃষকের পক্ষে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারন, কৃষক এখনো মাঠে আছে বলেই আমরা খেতে পারছি। সেই কৃষক যাতে কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়, এদেশের তরুন, যুবকরা যাতে কৃষিকে পেশা হিসেবে নিয়ে তাদের কর্মসংস্থান তৈরী করতে পারে, দেশের ক্রমবর্ধমান মানুষের জন্য যাতে প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান অব্যাহত থাকে তার জন্য সকলেই যার যার অবস্থান থেকে কৃষকের পাশে দাড়ানো প্রয়োজন। কৃষক, উৎপাদক, উদ্যোক্তা, খামারীদের যারা শোষন করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। সমৃদ্ধ হোক দেশের কৃষি।
লেখকঃ এগ্রোনমিস্ট অ্যান্ড কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ