ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) ও মদিনা সনদ: মানবিক মূল্যবোধের উদাহরণ এবং শান্তির বার্তা

কৃষিবিদ ড. এস.এম. রাজিউর রহমানঃ আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) আমাদের জীবনে এক মহিমান্বিত দিন। এই দিনে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) পৃথিবীতে আসেন, মানবজাতির জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে। তাঁর আগমন একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে, যখন আরব সমাজ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, এবং নৈতিক অবক্ষয় ছিল সর্বত্র।

এই সময়কে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বলা হয়, যা মানব জাতির এক দুর্বিষহ অবস্থা নির্দেশ করে। সমাজে তখন হানাহানি, লুটতরাজ, এবং অন্যায় কার্যকলাপ চলত, যেখানে মানবিক গুণাবলীর অভাব ছিল প্রবল। এই অন্ধকার যুগ থেকে মানবজাতিকে মুক্তির আলোকবর্তিকা দেখাতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় নবীকে (স.) মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে পাঠান। নবীজির আগমন ছিল স্রষ্টার পক্ষ থেকে অশেষ দয়া ও অনুগ্রহ।

নবী মুহাম্মদ (স.) শুধু ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, বরং একজন রাষ্ট্রনায়ক, সামাজিক সংস্কারক এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রচারক ছিলেন। তিনি মদিনায় একটি বহুজাতিক ও বহুধর্মী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। এই সনদ ছিল পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান, যার মাধ্যমে সব ধর্ম, বর্ণ, এবং সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে সাম্য, স্বাধীনতা এবং শান্তির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল।

মদিনা সনদে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সহিষ্ণুতা, এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল, যা আজকের সমাজে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। মদিনা সনদের অন্যতম শিক্ষা হলো ভিন্নমত এবং ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের মানুষদের মধ্যে শান্তি এবং সৌহার্দ্য স্থাপন করা। এই সনদে প্রত্যেকের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছিল এবং একে অপরের ধর্মীয় আচরণে হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ছিল। নবীজির (স.) এই মহানুভবতা এবং সহিষ্ণুতার পরিচয় আজকের বিশ্বেও অনুকরণীয়।

বর্তমান সমাজে যখন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে নানা বিরোধ দেখা দেয়, তখন মদিনা সনদের শিক্ষা আমাদেরকে সম্প্রীতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের সমাজে আজও মদিনা সনদের শিক্ষাগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতিগত সংঘাত এবং সামাজিক বৈষম্য দেখা দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মদিনা সনদের শিক্ষাগুলি বাস্তবায়ন করে সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা, এবং আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সহিষ্ণুতা, এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে পারি, তবে আমাদের সমাজেও উন্নত এবং শান্তিময় পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। এভাবে একটি সুষ্ঠু, অসাম্প্রদায়িক এবং বৈষম্যহীন সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে। মদিনা সনদের চেতনা অনুসরণ করে আমাদেরকেও আজকের পৃথিবীতে সংহতি, মানবিক মূল্যবোধ, এবং সমান অধিকারের সমাজ গঠনের জন্য উদ্যোগী হতে হবে।