জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি

সমীরণ বিশ্বাস: পরিবর্তিত জলবায়ু উপযোগী কৃষি (climate resilient agriculture) বলতে অভিযোজন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং সর্বস্তরে উপযোগী জীববৈচিত্র্য আনায়ন ইত্যাদি বোঝায় যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে টেকসই কৃষির উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান ফসলের ওপর ইতিমধ্যে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে প্রধান ফসল ধান, ভুট্টা, আলু, ফুল, নারিকেল, লেবু জাতীয় ফল, পেয়ারা, লিচু ও পেঁপেতে বৈরী প্রভাব তৈরী হয়েছে। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সার্বজনীন সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি, শিশু বিবাহ ও শিশু শ্রম বন্ধ এবং ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণের মতো বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক অর্জনগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন।

ভৌগলিক অবস্থান ও বিপুল জনগোষ্ঠীর কৃষির উপর নির্ভরশীলতার কারনে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির তালিকায় বাংলাদেশ উপরের দিকে অবস্থান করে। খরা, লবনাক্ততা, বন্যা, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছাস, বহিঃদেশের বালাইয়ের অনুপ্রবেশ, নদী ভাঙ্গন ইত্যাদি বাংলাদেশের কৃষিকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে। বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি যোগানের পাশাপাশি কর্ম সংস্থান সৃষ্টি, আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও দারিদ্র দূরীকরণে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই ক্ষুদ্র দেশের বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু কৃষি জমির উপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অব্যাহত চাপ, প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়া।

কৃষিতে জলবায়ুর প্রভাব আজ আর তেমন অজানা নহে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে নানা প্রকারের দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন- অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছাস, উজানের ঢল, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি। যার ফলশ্রুতিতে ফসল, জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণে প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার ফসল ও সম্পদ। ঝড়, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন প্রকার সমস্যা বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে যার ফলে প্রতি বৎসরে লক্ষ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হচেছ আমাদের কৃষি। এই অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে হলে আমাদেরকে এই পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়াতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব : ধান চিটা হয়, অতি বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়, জমিতে লবনাক্ততা বৃদ্ধি পায়, খড়ায় ফসলে পোকার আক্রমন বেশী হয়, ফসলের বৃদ্ধি কম হয় এবং ফলন কমে যায়, সঠিক সময় বীজতলা করা যায় না, বন্যা/অতিবৃষ্টিতে সবজি পঁচে যায়, খড়ায় পোকার আক্রমন বেশী এবং ফলফুল ঝড়ে যায়, সময়মত ফসলের চাষাবাদ করা যায় না, কুয়াশায় পরাগায়ন ব্যাহত হয়, আমের মুকুল ঝড়ে যায়, আলুর মড়ক দেখা যায়, রবি শষ্যের ফলন কমে যায়। বাংলাদেশে পানিসম্পদে সমৃদ্ধ হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি, বন্যা ও জলাবদ্ধতার প্রকোপ ক্রমাগত বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি প্রতি বছর বন্যাকবলিত হয়।

জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে করনীয়:
খড়া, বন্যা, লবন, তাপ এবং ঠান্ডা সহিষ্ণু স্মার্ট জাত রোপন বা চাষাবাদ করতে হবে, উঁচু স্থানে বেড ও মাদা তৈরী করা, পলিথিন নিয়ে বেড, মাদা ঢেকে দেওয়া, বন্যা /পানি সহিষ্ণু জাত ব্রি ধান- ৫১, ৫২,৭৯ বিআর - ২২, ২৩ চাষ করা, বেরি বাঁধ ভাঙ্গলে মেরামত করা, মাছের ক্ষেত্রে উঁচু করে পাড় মেরামত করা নেট দেওয়া, স্বল্প মেয়াদী ধানের চাষ করা, বিনা ধান -৭, ১৬ ব্রি ধান -২৮,৩৩,৩৯,১০০, বাউ ধান -১, স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি- ভাসমান বীজতলা তৈরী করা, কচুরী পানায় মাদা বা বেড তৈরী করা এবং ভাসমান মাদায় সবজি এবং ফল চাষ করা, পুকুর খনন করে পাড় উঁচু করা, আগাম কৃষি আবহাওয়ার সার্বিক তথ্য পূর্বেই জানিয়ে দেওয়া (ওয়েদার ফোরকাস্টিং), বন্যার পূর্বে বিভিন্ন প্রকার খাবার সংগ্রহ করে রাখা, মাছ আগে ধরে কোথাও বিক্রি করা, হাঁস মুরগীর প্রতিশেধক টীকা বন্যার পূর্বে দেওয়া, হাঁস মুরগীর ঘরের মেঝ চুন/ ছাই ছিটানো, বন্যার পানি সরে গেলে রোপা আমন মৌসুমের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শাইল জাতের যেমন: বিনা শাইল, নাইজার শাইল, ঝিংগা শাইল,রাজু শাইল,ইন্দ্রো শাইল সহ স্থানীয় জাতের ধান চাষ করা।

তাছাড়া কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে অভিযোজিত জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রতিটি খাতে জলবায়ু সহনশীল গবেষণায় নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান পরিস্থিতি (পরিসংখ্যান)-বাংলাদেশ ও বিশ্বের বন্যা, খরা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির বিগত ডাটা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ও জলবায়ু সম্মেলন কপ- ২৭, ২৮ কে পরিকল্পনায় রেখে, সরকারের ডেল্টা প্ল্যান ২০২১ এর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার কারণে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড, বৈশ্বিক উষ্ণতা, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে ভেক্টর বাহিত রোগ, ভাপ-প্রবাহ, তাপমাত্রার চাপ, বায়ু দূষণ এবং খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তি :
এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) হয়ে উঠেছে শিক্ষা এবং আধুনিক কৃষি ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনার অংশ। ইতি মধ্যে কৃষিতেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা,আইওটি (IoT), ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার শুরু হয়েছে। কৃষিতে AI প্রযুক্তি সম্বলিত মোবাইল অ্যাপ উদ্ভাবন হয়েছে। এ অ্যাপ দিয়ে ফসলের আক্রান্ত স্থানের ছবি তুললেই ,বলে দিবে আপনার ফসলের সমস্যা ও সমাধান এবং কৃষিতে AI প্রযুক্তি সম্বলিত ড্রোন অর্থাৎ ড্রোনের সঙ্গে AI কাস্টমাইজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ইন্টিগ্রেট করলে ড্রোন একবার ফসলের খেতের উপর দিয়ে উড়ে গেলে ঐ এলাকার যে সার্বিক অবস্থা জানান দিতে আগামীতে সক্ষম তা হলোঃ ফসলের মাঠের আদ্রতা পরিমাপ করা, ফসলে উপাদানের উপস্থিতি নির্ধারন করা, শস্য রোপন ডিজাইন করা, বীজ রোপন করা , পোকার আক্রমন জানা ( ইমেজ প্রযুক্তি), কীটনাশক স্প্রে করা , সেচ মনিটরিং করা , ফসলের উৎপাদন জানা, ফসলের সর্বিক মনিটরিং করা, মাটির নিউট্রেন্ট, আদ্রতা, তাপমাত্রা, পিএইচ, লবনাক্ততা জানা, ফসলের নিউট্রেন্ট এর অভাব জানা, ফসলের রোগ ও পোকামাকড় জানা উপস্থিতি জানা, কৃষি ওয়েদার ফোরকাস্টিং এন্ড আগাম এর্লামিং দেয়া, ফসলের আগাম সম্ভাব্য ফলনের পূর্ভাবাস দেয়া ইত্যাদি।

এই (AI) প্রযুক্তির প্রতিটি অনুসর্গই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষি বিনির্মাণ করে কৃষিকে স্মার্ট তথা স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে । আগামীতে কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI প্রযুক্তি) সম্প্রসারন করে ; পরিবর্তিত জলবায়ু উপযোগী কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে- কৃষিকে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার এখনই সময়।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।