সম্ভাবনাময় আম রপ্তানিতে বাংলাদেশ

সমীরণ বিশ্বাস: আম এমন একটি ফল যাv অর্থনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক পরিধির। ভালো স্বাদ ছোট-বড় মকলের নিকট প্রিয় এ ফল ভিটামিন 'এ' ও 'সি' পুষ্টিগুণে ভরপুর। আম গাছের কাঠ বাড়ি ঘরের জানলা তৈরীর কাজে ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে ১২ লাখ ২২ হাজার টন। দেশে ২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে আমবাগান রয়েছে। প্রতিটি গাছে গড়ে ৭৭ কেজি করে আম উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশ থেকে ২০১৮-১৯ সালে ৩১০ টন, ২০১৯-২০ সালে ২৮৩ টন, ২০২০-২১ সালে ১৬৩২ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭৫৭ মে. টন আম রফতানি হয়েছে। আম উৎপাদনে বাংলাদেশ ৭ম অবস্থানে থাকলেও রফতানিতে শীর্ষ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নাই। বাংলাদেশ থেকে প্রায় লক্ষাধিক টন আম রফতানির সম্ভবনা রয়েছে। অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে আমের উৎপাদন ২৪ লাখ টনের মতো। প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্য হয়। আম উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন, মোড়কীকরণ ও পরিবহন মিলিয়ে এ বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর এপ্রিলে কাঁচা আম বাজারে আসা থেকে শুরু হয় এ বাণিজ্য। চলে সেপ্টেম্বরে আশ্বিনা আম বিপণন শেষ হওয়া পর্যন্ত। সংবাদ মাধ্যমে সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক মেহেদী মাসুদ বলেন, দেশে প্রতিবছর আমের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। ফলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে আম রপ্তানির সুযোগও তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের যে সকল এলাকায় আম চাষ হয় তার ভিতরে উল্লেখযোগ্য সাতক্ষীরা নওগাঁ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মেহেরপুর এবং তিন পার্বত্য জেলা। চলতি বৎসর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ডিএ ই রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় দেশে এই প্রথম রপ্তানি বাজার লক্ষ্য রেখে আম উৎপাদনের জন্য উদ্যোক্তাদের সাময়িকভাবে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে এই প্রকল্পের লক্ষ্য প্রাথমিকভাবে ৯৩০ উদ্যোক্তাকে বেছে নেওয়া হলেও আগামী চার বছরের মধ্যে এই সংখ্যাটি ৮৪০০ জনে উন্নীত করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ।

সংশ্লিষ্ট চাষীগণ বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আম উৎপাদন করছেন কারণ এসব আম বিদেশে যাবে ইতিমধ্যে নির্ধারিত চাষীগণ বালাইনাশক, সার, ফলের ব্যাগিং সহ (ফ্রুট ব্যাগ) নানা কৃষি উপকরণ পেয়েছেন সঙ্গে পেয়েছেন বিশেষ প্রশিক্ষণ। কেননা রপ্তানি আমের জন্য বিশেষ যত্ন দরকার হয়। আমের শত্রু মাছি পোকা। এই পোকা ঠেকাতে আমের বয়স ৪৫ থেকে ৫০ দিন হলেই ফলের গায়ে ব্যাগ পড়াতে হয়। পাশাপাশি কীটনাশক ব্যবহারের একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর আম পাড়তে হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ৯৩০ জন বাগানের আম রপ্তানি হবে এমনটি নয়। এই নির্ধারিত কৃষকের বাহিরেও নানা উদ্বেগে, মান অনুসরণ করে আম রপ্তানি করে হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের আম স্বাদ গন্ধ ও পুষ্টিমানের দিক দিয়ে ভালো মানের বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষিবিদরা তাই বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আমের চাহিদাও রয়েছে বিদেশে থাকা এক কোটি বাংলাদেশের একটা বড় বাজার রয়েছে বাহিরের দেশে কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। গত অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাজ্য সৌদি আরব ইতালি কাতার কুয়েতে।

ফলবাজার নিয়ে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর পর্যালোচনা প্রতিবেদন বলেছে সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান রয়েছে। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করেছে মেস্কিকো ৪ লাখ ৬৮ হাজার টন। থাইল্যান্ড রপ্তানি করেছে প্রায় তিন লাখ চল্লিশ হাজার টন আম। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক জানিয়েছেন এবার আম গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থাৎ চার হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানি করবেন বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। এই জন্য খামারিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেশের আম রপ্তানির কিছু বাধা চিহ্নিত করেছেন তা হলো; মানসম্মত নিরাপদ আম উৎপাদন করা হয় না। আম সংগ্রহের পর ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমদানিকারকদের দেয়া শর্ত পূরণ করা হয় না। আম উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় কৃষক, সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, গবেষক এবং রপ্তানিকারকদের সমন্বয়ের অভাব। আম সংগ্রহের পর আমের গুণগত মান বজায় রেখে বাছাই বা গ্রেডিং, মোড়কজাতকরণ ,শীতলীকরণ ব্যবস্থাসম্বলিত বাহনের (কুলিং ভ্যান) মাধ্যমে পরিবহন না করা।

আম উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য মোড়কজাত করতে ঢাকার শ্যামপুরের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। সেখানে ডিএইর অধীনে রপ্তানির জন্য মোড়কজাতের ব্যবস্থা রয়েছে। যার নাম সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউস। আম উৎপাদনকারী জেলাগুলির সাথে এই প্যাকেটিং হাউজের দূরত্ব অনেক। তাই এত দূর থেকে আম এনে মান ধরে রাখা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন বিভিন্ন উপজেলার বা জেলার আম চাষী গন। স্থানীয় আম চাষীগন আরো মনে করেন যে, প্রধান আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে একটি করে প্যাকিং হাউস নির্মাণ করা অতীব জরুরি। আম বিদেশে পাঠানোর জন্য দরকারি উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বা ফাইটো স্যানিটারি সনদ পেতে দীর্ঘসূত্রিকা এবং উড়োজাহাজের উচ্চ হারে ভাড়া প্রদান যা প্রতিযোগী দেশ ভারত, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ডের উড়োজাহাজ ভাড়ার চেয়ে আমাদের দেশে ভাড়া অনেক বেশি।

গাছের আম ব্যাগিং পদ্ধতি গ্রহণ করলে নিরাপদ বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য এটি একটি সহজ ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি হিসেবে মাঠ পর্যায়ে পরিচিত লাভ করেছে। পরিশেষে নিরাপদ বিষমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত আমের উৎপাদন বৃদ্ধি হোক এটি সবার প্রত্যাশা আমাদের আম চাষিরা ভালো মানের গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদনে উপরোক্ত বিষয় সমূহ ভালোভাবে অনুসরণ করবেন তাহলেই ভালো মানের আম উৎপাদন নিশ্চিত হবে।

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।