ধানের বাদামী গাছ ফড়িং ব্যবস্থাপনা

Category: এগ্রিবিজ এন্ড টেক্ Written by Shafiul Azam

সমীরণ বিশ্বাসঃ বাদামী গাছফড়িং এর ইংরেজি নামঃ Brown Plant hopper (BPH) Delphacidae গোত্রের নামঃ Nilaparvata lugens (Stal) প্রজাতির সাধারণ নাম। সবুজ ধানের অন্যতম শত্রু বাদামী গাছফড়িং। এটি কারেন্ট পোকা নামেও পরিচিত। এরা খুব তাড়াতাড়ি বংশ বৃদ্ধি করে, ফলে এ পোকার সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, আক্রান্ত ক্ষেতে বাজ পড়ার মত হপারবার্ণ এর সৃষ্টি হয়।

আকার আকৃতি:
এগুলোর গায়ের রঙ বাদামি বা গাঢ় বাদামী। পূর্নবয়স্ক পোকা লম্বা ও খাটো দু’ধরনের হয়ে থাকে। এগুলোর দেহ খুবই নরম এবং স্ত্রী পোকার পেট পুরুষ অপেক্ষা বেশ বড়ো। পূর্নবয়স্ক পোকা ৩.৫-৫.০ মি.মি. লম্বা। স্ত্রী পোকা পুরুষ অপেক্ষা বড়।

জীবন চক্র:
বাদামি গাছ ফড়িং এর জীবনচক্রে তিনটি স্তর আছে। এ স্তর গুলো হচ্ছে ডিম, বাচ্চা এবং পূর্ণাঙ্গ। পূর্ণবয়ষ্ক স্ত্রী ফড়িং খোল পাতার ভিতরে গুচ্ছ আকারে ৮-১৬ টি ডিম পাড়ে। ৪-৯ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। প্রথম পর্যায়ে বাচ্চা ৫ বার তাদের খোলস বদলায়। বাচ্চাগুলোর রং সাদা থাকে এবং পরে বাদামি রং ধারন করে। বাচ্চা থেকে খাটো ও লম্বা পাখা-বিশিষ্ট উভয় ধরনের পূর্ণ বয়স্ক ফড়িং হতে পারে। সাধারণত ধান পেকে গেলে লম্বা পাখা বিশিষ্ট পূর্ণ বয়স্ক ফড়িং দেখা যায়। পূন বয়স্ক পোকার গায়ের রং বাদামী। আকারে প্রায় ৪ মিলিমিটার লম্বা। বাচ্চা থেকে পূর্ণ বয়স্ক ফড়িং -এ পরিণত হতে আবহাওয়া ভেদে ১৪-২৬ দিন সময় লাগে। পূর্ণ বয়স্ক বাদামি গাছ ফড়িং প্রায় ৩ সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে। বাদামি গাছ ফড়িং এর একটি জীবন চক্র শেষ হতে আবহাওয়া ভেদে ২১-৩৩ দিন সময় লাগে এবং অনুকুল আবহাওয়ায় বছরে ১০-১১ বার বংশ বিস্তার করতে পারে। এক জোড়া (পুরূষ ও স্ত্রী) পোকা থেকে দু‘এক মাসের মধ্যে হাজার হাজার পোকা জন্ম নিতে পরে।

বংশ বিস্তারের অনুকুল পরিবেশ:
এদের বেঁচে থাকা ও বংশ বিস্তারের জন্য আদ্র্র্র ও ছায়াযুক্ত স্থান খুবই প্রয়োজন। যে সমস্ত জমি সব সময় ভিজা থাকে বা কিছু পানি জমে থাকে সে সকল জমিতে এ পোকার আক্রমন বেশি হয়। ঘন করে চারা রোপন করলে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করলে এ পোকার আক্রমন বেশি হতে পারে। জমি থেকে নিয়মিত আগাছা পরিস্কার না করলে এবং সারি করে চারা রোপন না করলে এ পোকার আক্রমন বেশি হতে পারে। ১২-৩১ সেঃ তাপমাত্রায় এ পোকার বংশ বিস্তার বেশি হয়। এরা আলোবাতাস পছন্দ করে না। ভেজা স্যাতস্যাতে জায়গার কাছাকাছি এরা বাস করে। এ পোকার বাচ্চা ও পূণবয়স্ক উভয় অবস্থায়ই ধান গাছের গোড়ায় বসে গাছের রস চুষে খায়। এর ফলে ধান গাছ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পোকার সংখ্যা অধিক হলে আক্রান্ত ফসলে বাজ পোড়ার মত (হপার বান) অবস্থার সৃস্টি হতে পারে।

আক্রমণের লক্ষন:
বাদামী গাছ ফড়িং বাংদাদেশে ধান ফসলের জন্য বর্তমানে একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর পোকা। বোরো, আউশ এবং রোপা আমনের উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতেই এ পোকার আক্রমন সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক উভয় অবস্থায় ধান গাছের গোড়ায় কান্ড এবং পাতার খোল থেকে রস শুষে খায়। এক সাথে অনেকগুলো পোকা রস শুষে খাওয়ার ফলে প্রথমে হলদে ও পরে শুকিয়ে মারা যায় এবং দূর থেকে পুড়ে যাওয়ার মত দেখায়। এ ধরনের ক্ষতিকে ইংরেজিতে ”হপার-বার্ণ” বা ফড়িং পোড়া বলা হয়। ধানে শীষ আসার সময় বা তার আগে হপার বার্ন হলে কোন ফলনই পাওয়া যায় না। তবে ধানের দানা শক্ত হওয়ার পর হপার-বার্ন হলে ২০-৪০% ক্ষতি হয়। সাধারনত ধানের কুশি গজানো অবস্থা থেকে ধান পাকা অবস্থা পর্যন্ত আক্রমন করতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি আক্রমন করে কাইচ থোড় অবস্থা থেকে দুধ অবস্থা পর্যন্ত। এবং ধান গাছের গোড়ায় বসে রস শুষে খায়। ফলে গাছ পুড়ে যাওয়ার রং ধারণ করে এক বলা হয় হপার বার্ন বা কড়িপোড়া।

জৈব ব্যবস্থাপনা:
১. বাদামী গাছ ফড়িং সহনশীল জাতের চাষ করা।
২. ধানের চারা ভেদে দু‘সারির মাঝে ১০-১২ ইঞ্চি ফাঁকা রাখুন এবং ৮-১০ ইঞ্চি দুরে দুরে চারা লাগান।
৩. ১০ সারি পর পর ১ সারি বাদ রেখে ল্যাগ পদ্ধতি অনুসরন করূন। এতে করে ধানে ক্ষেতে প্রচুর আলো বাতাস প্রবেশ করবে। ফলে বাদামী গাছ ফড়িং এর আক্রমণ কম হবে। তবে ফলনে কোন কম হবে না।
৪. প্রতি সপ্তাহে অন্ততঃ একবার ধানক্ষেত পর্যাবেক্ষ ও জরিপ করে পোকার উপস্থিতি যাচাই করূন।
৫. বাদামী গাছ ফড়িং এর উপস্থিতি নিণয়ের জন্য ধানক্ষেতের পাশে সন্ধ্যার পর ৩ ঘন্টা আলোক ফাঁদ স্থাপন করতে হবে।
৬. সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করূন। ইউরিয়া সার বেশী মাত্রায় ব্যবহার করলে চারা বেশী সবুজ ও রসালো হয়, ফলে পোকার আক্রমন বেড়ে যায়। তাই এলসিসি ব্যবহার করে পরিমিত মাত্রায় ইউরিয়া সার ২ থেকে ৩ বারে ব্যবহার করূন।
৭. আক্রান্ত ক্ষেতের আগাছা , মরা পাতা, খোল ইত্যাদি পরিস্কার করে ক্ষেতে বেশী আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন।
৮. ধানের জমিতে সব সময় পানি আটকে না রেখে মাঝে মাঝে জমি শুকিয়ে ফেলুন। এতে পোকার আক্রমন ও বংশ বৃদ্ধি কমে যাবে।
৯.এ পোকার বিকল্প পোষক আঙ্গুলী ঘাস ধবংস করতে হবে।
১০. ধান ক্ষেতে বাদামী গাছ ফড়িং এর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হলে ধান ক্ষেতে ২ হাত পর পর ফাঁড়ি/ বিলি করে দিয়ে ক্ষেতে আলো বাতাস প্রবেশের সুযোগ করে দিন।
১১. স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন ধানের জাতের চাষ করতে হবে।
১২. বাদামি গাছ ফড়িং এর আক্রমণ হলে, গ্রামের সবাই মিলে এ পোকা দমনের জন্য জরুরি বিভক্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৩. খেতে ধান শতকরা ৮০ভাগ পেকে গেলে দেরি না করে ধান কেটে ফেলতে হবে ।

রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা:
উপরোক্ত পদ্ধতিতে বাদামী গাছ ফড়িং দমন করা সম্ভব না হলে তখনই কেবল শেষ ব্যবস্থা হিসাবে পাইমেট্রোজিন+ডিনটিফুরনি (ইবু), বা নিতেনপাইরাম (সেগা) জাতীয় কীটনাশক ( যেমন-ইবু বা সেগা ইত্যাদি) আক্রান্ত গাছের গোড়ায় সঠিক মাত্রায় স্প্রে করূন। নিকটস্থ কৃষি অফিসের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।