কৃষিবিদ রণজিৎ দেবনাথ:বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় বাস্তবতা হল জলবায়ু পরিবর্তন। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কৃষি ও মৎস্য খাতে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মতো সমুদ্রঘেঁষা অঞ্চলে। এল-নিনো এবং লা-নিনা আবহাওয়া ব্যবস্থার চক্রে তাপমাত্রার অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হচ্ছে—ফলে খরা, অনাবৃষ্টি, অতিরিক্ত গরম এবং ভ্যাপসা পরিবেশ মাছচাষের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন, ২০২৪ ও ২০২৫ সাল হতে পারে রেকর্ড করা ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছরগুলোর একটি। আমরা কিন্তু ২০২৪ সালে এই ভবিষ্যৎ বাণীর বাস্তবতা লক্ষ্য করেছি। এখন ২০২৫ সাল চলমান, তাই মৎস্যচাষীদের উচিত চাষ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করা।
ভ্যাপসা গরমে মৎস্যচাষে ঝুঁকি ও করণীয়সমূহ:
১. পানির রসায়ন ও তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনা
* অতিরিক্ত তাপমাত্রা মাছের জন্য স্ট্রেস তৈরি করে এবং তাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে দেয়।
* পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে দ্রবীভূত অক্সিজেন (DO) হ্রাস পায়, অ্যামোনিয়া ও pH মাত্রা বেড়ে গিয়ে মাছের শ্বাস ও বিপাকে বিঘ্ন ঘটে।
করণীয়:
o খাদ্যপ্রদান সকাল ৯টার আগেই এবং সূর্যাস্তের পর করুন।
o সহজে হজমযোগ্য, উচ্চ মানের খাবার ব্যবহার করুন।
o পানিতে বেকিং সোডা ও ইউকা প্রয়োগ করতে পারেন অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণে।
২. পানির গভীরতা ও পানিস্তর নিয়ন্ত্রণ
* সম্ভব হলে পুকুর খনন করার সময় কম পক্ষে ৬-৭ ফুট গভীর করুন।
* কমপক্ষে ৫-৬ ফুট গভীরতা বজায় রাখুন যাতে তাপমাত্রা সামঞ্জস্য বজায় থাকে।
* পুকুরে পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণ ও যোগান (যেমন: ডিপ টিউবওয়েল, খাল, নদী ইত্যাদি) রাখতে হবে।
৩. এরেশনের (Aeration) ভূমিকা
* ভোর রাত ৩টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত অক্সিজেনের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি হয়।
* এ সময় এরেটর চালানো বাধ্যতামূলক, তবে দিনে এয়ারেটর চালানো থেকে বিরত থাকুন যাতে পানির তাপমাত্রা আরও না বাড়ে।
৪. সার প্রয়োগ ও প্ল্যাংকটনের ভূমিকা
* গ্রীষ্মকালে রাসায়নিক বা জৈব সার প্রয়োগ একেবারে বন্ধ রাখুন।
* পানিতে পরিমিত পরিমাণে প্রাকৃতিক ফাইটোপ্ল্যাংকটন রাখুন, যা অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং অতিরিক্ত সূর্যরশ্মি গভীরে যেতে বাধা দেয়।
৫. মাছের ঘনত্ব ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
* অতিরিক্ত ঘনত্বে মাছ চাষ করা অক্সিজেন ঘাটতি ও স্ট্রেস বাড়ায়।
* প্রয়োজনে মাছ কম ঘনত্বে স্থানান্তর করুন অথবা অন্য পুকুরে ছড়িয়ে দিন।
* পুকুরের তলদেশে হররা টেনে দিন, যাতে বিষাক্ত গ্যাস জমে না থাকে।
৬. রোগ প্রতিরোধ ও জৈব নিরাপত্তা
* তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মাছের রোগ প্রবণতা বেড়ে যায় (যেমন: এ্যারোমোনাস, ফিন রট, স্ট্রেপ্টোককোসিস ইত্যাদি)।
* খাদ্যে ভিটামিন-সি, ইমিউন বুস্টার, এনজাইম ব্যবহার করুন।
* জৈব নিরাপত্তা বজায় রাখতে পুকুরে নামার আগে পায়ের গামবুট বা জুতা জীবাণুনাশক পানিতে ডুবিয়ে নিন, জাল জীবাণুমুক্তকরণ, সরঞ্জাম শেয়ার না করা ইত্যাদি মেনে চলুন।
৭. ছায়া ও প্ল্যাটফর্ম ব্যবস্থা
o সরাসরি সূর্যরশ্মি ঠেকাতে যদি সম্ভব হয়, পুকুরের কিছু অংশে ছায়া দিন, আপনি পুকুরের কোণে একটি ব্যারিকেড দিয়ে কচুরিপানা রাখতে পারেন। অতিরিক্ত গরমে, সরাসরি সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে মাছ এতে আশ্রয় নিতে পারে। ।
o ১ ফুট উপরে কাঠ বা টিনের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে উপর থেকে ঠান্ডা পানি ঢালুন।
চোখ-কান খোলা রাখুন, পানি ও পুকুর পর্যবেক্ষণ করুন, প্রয়োজনে অভিজ্ঞ মৎস্যবিদের পরামর্শ নিন এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিন
লেখক: হেড অব মার্কেটিং (ফিশ ফিড) ও ডিজিএম, স্পেক্ট্রা হেক্সা ফিডস লিমিটেড (মেগা ফিড) এন্ড স্পেক্ট্রা হেক্সা নামসাই কোম্পানি লিমিটেড