কৃষিতে 4IR : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নতুন দিগন্ত

Category: এগ্রিবিজ এন্ড টেক্ Written by Shafiul Azam

সমীরণ বিশ্বাস:কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলেও ফসলের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সময়মতো রোগ ও ক্ষতিকর পোকা শনাক্ত করতে না পারলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের আর্থিক অবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রচলিত পদ্ধতিতে রোগ শনাক্তকরণ সাধারণত কৃষি বিশেষজ্ঞের উপর নির্ভরশীল, যা সময়সাপেক্ষ এবং সব অঞ্চলে সহজলভ্য নয়। এই প্রেক্ষাপটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা AI) প্রযুক্তি কৃষিক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনাময় সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

AI-ভিত্তিক প্রযুক্তি যেমন মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং এবং কম্পিউটার ভিশন ব্যবহার করে ফসলের পাতার ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে রোগ ও পোকামাকড় শনাক্ত করা সম্ভব। স্মার্টফোন বা ড্রোনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা ছবির উপর ভিত্তি করে AI সিস্টেম রোগের ধরন নির্ধারণ করতে পারে এবং উপযুক্ত প্রতিকার বা কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারে। এর ফলে কৃষকরা কম খরচে, কম সময়ে এবং পরিবেশবান্ধব উপায়ে সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হন। সুতরাং, কৃষিতে AI প্রযুক্তির ব্যবহার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, ক্ষতি হ্রাস এবং টেকসই কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

4IR এ কৃষি ভাবনা:

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (4IR) কৃষি খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে কৃষি আজ আর শুধু অভিজ্ঞতাভিত্তিক নয়, বরং তথ্য, ডেটা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর এক স্মার্ট ব্যবস্থায় রূপ নিচ্ছে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ও জনবহুল দেশে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে 4IR প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য।

কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ফসলের রোগ শনাক্তকরণ, উৎপাদন পূর্বাভাস, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা নির্ভুল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। AI-ভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কৃষকরা আগাম সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন, ফলে উৎপাদন খরচ কমছে এবং ফলন বাড়ছে। অন্যদিকে IoT (Internet of Things) প্রযুক্তির মাধ্যমে মাঠের মাটি, আবহাওয়া ও ফসলের অবস্থা রিয়েল-টাইমে পর্যবেক্ষণ সম্ভব হচ্ছে। এতে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সেচ ও সার প্রয়োগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে।

বিগ ডেটা কৃষি ব্যবস্থাপনায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়া তথ্য, মাটির গুণাগুণ, বাজার মূল্য ও উৎপাদন তথ্য বিশ্লেষণ করে কৃষি নীতিনির্ধারণ ও মাঠপর্যায়ের সিদ্ধান্ত আরও কার্যকর হচ্ছে। পাশাপাশি ড্রোন প্রযুক্তি ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, সার ও বালাইনাশক স্প্রে এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করতে সময় ও শ্রম সাশ্রয় করছে।

এছাড়া সয়েল সেন্সর প্রযুক্তি মাটির NPK, আর্দ্রতা, pH, তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা রিয়েল-টাইমে জানিয়ে দেয়, যা সুনির্দিষ্ট কৃষি (Precision Agriculture) বাস্তবায়নে সহায়ক। ফলে অতিরিক্ত সার ব্যবহার কমে, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা পায় এবং পরিবেশ দূষণ হ্রাস পায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, খরা, বন্যা, লবণাক্ততা ও অনিয়মিত আবহাওয়া মোকাবেলায় ডিজিটাল কৃষির বিকল্প নেই। 4IR প্রযুক্তির সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক, জলবায়ু-সহনশীল ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলাই আগামী দিনের কৃষি ভাবনার মূল ভিত্তি।

কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তি:

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের কৃষি খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence–AI) প্রযুক্তির ব্যবহার একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছে। এর একটি বাস্তব ও কার্যকর উদাহরণ হলো ডা.চাষী অ্যাপ, যা কৃষকদের জন্য ডিজিটাল কৃষি সহায়তা নিশ্চিত করছে। এটি বাংলাদেশের কৃষিতে মাঠ পর্যায়ে ব্যবহৃত সর্বপ্রথম এআই প্রযুক্তির মোবাইল অ্যাপ ডা.চাষী। এই অ্যাপের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল: তাৎক্ষণিক, রিয়াল টাইম রোগ ও পোকামাকড় শনাক্তকরণ এবং সমাধান। জৈব ও রাসায়নিক সমাধানের সুপারিশ। আবহাওয়ার পূর্বাভাস। ফসল ও লোকেশন বেইজ সারব্যবস্থাপনা। ই-কমার্স  এবং ট্রেনিং ও পরামর্শ সেবা প্রদান করা। বর্তমানে ডা. চাষী অ্যাপের মোট সাধারণ ব্যবহারকারী প্রায় ৮৭,০০০ জন। এর মধ্যে ৩০% (প্রায় ২৫,৮০০ জন) সরাসরি কৃষক। এছাড়াও ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৭% ছাত্র ও যুবক-যুবতী, ৭% বিজ্ঞানী ও কৃষি পেশাজীবী, এবং বাকি ২৬% অন্যান্য শ্রেণির মানুষ। এই পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে ডা. চাষী অ্যাপটি শুধু কৃষকদের মধ্যেই নয়, বরং নতুন প্রজন্ম ও পেশাজীবীদের মাঝেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে। উৎপাদনশীলতা ও খরচ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক ।

কৃষিতে প্রযুক্তির প্রভাব :

কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তি ডা. চাষী অ্যাপ ব্যবহারের ফলে কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। আপনি মাঠ ফসল এবং ছাদ বাগানের রোগ ও পোকামাকড় নিয়ে চিন্তিত ? কৃষকের  সক্ষমতা বৃদ্ধিতে AI প্রযুক্তি ভিত্তিক ডা.চাষী একটি ডিজিটাল ফার্মিং সিস্টেম। আজই আপনার মোবাইলে ডা.চাষী (Dr.Chashi) অ্যাপ ডাউনলোড করুন এবং ফসলের আক্রান্ত স্থানের ছবি তুলুন, তা হলেই ডা.চাষী বলে দিবে আপনার,  ফসলের সমস্যা ও সমাধান। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় : কৃষক ডা. চাষী অ্যাপ ব্যবহারের ফলে, ফসলের ফলন ১২–১৬% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। কীটনাশকের ব্যবহার ২৫–৩০% কমেছে। সারের ব্যবহার প্রায় ১১% হ্রাস পেয়েছে। এবং সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৩৩%। এই অর্জনগুলো প্রমাণ করে যে AI-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত সহায়তা ব্যবস্থা কৃষকদের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করছে, ফলে অপ্রয়োজনীয় খরচ ও ঝুঁকি কমছে।

প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিতে যুবসমাজের সম্পৃক্ততা:

ডা. চাষী অ্যাপ ব্যবহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শিক্ষিত যুবক-যুবতী কৃষকদের উৎসাহ ও সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি। তারা কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তির পাশাপাশি IoT ভিত্তিক সয়েল সেন্সর, স্প্রে ড্রোন, এবং অন্যান্য স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করছে। এর ফলে কৃষিকে তারা একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও লাভজনক পেশা হিসেবে দেখছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক।

সার্বিকভাবে বলা যায়, ডা. চাষী অ্যাপ বাংলাদেশের কৃষিতে AI প্রযুক্তির কার্যকর প্রয়োগের একটি সফল মডেল। এটি একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি ও খরচ কমাতে সহায়তা করছে, অন্যদিকে তেমনি নতুন প্রজন্মকে কৃষিতে আকৃষ্ট করছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রযুক্তির বিস্তৃত ব্যবহার টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তুলবে।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।