কৃষকের উৎপাদিত ফসলের জন্য ন্যুনতম মূল্য সহায়তা নিশ্চিত করা ও মূল্য কমিশন গঠনের জন্য খানি বাংলাদেশ এর আহবান

Category: ফারমার্স এন্ড ফার্মিং প্রডাক্টস্ Written by Shafiul Azam

এগ্রিলাইফ২৪: ডটকম: কৃষকের উৎপাদিত ফসলের জন্য ন্যুনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ, মূল্য কমিশন গঠন, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ও চালের মতো অন্যান্য ফসল সরাসরি ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ, কৃষিজোনভিত্তিক কমিউনিটি সংরক্ষণাগার এবং হিমাগার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে খানি বাংলাদেশ। আজ বুধবার ২৩ এপ্রিল, ২০২৫ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রান্তিক কৃষকদের দীর্ঘদিনের মূল্য বঞ্চনার চিত্র এবং সম্প্রতি মেহেরপুরের পেঁয়াজ চাষী সাইফুল শেখের মর্মান্তিক আত্মহত্যার ঘটনায় সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরার সময় এই দাবি জানানো হয়।

গত ২৬ মার্চ পেঁয়াজ চাষে লোকসান এবং ঋণ পরিশোধ করতে না পারার চাপে মেহেরপুর মুজিবনগরের পেঁয়াজ চাষী সাইফুল শেখ নিজ জমিতে বিষপান করেন এবং ২৮ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ১৬ এপ্রিল ২০২৫, খানি বাংলাদেশ সদস্য সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, কৃষি গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক সমন্বিত একটি তথ্যানুসন্ধান দল ভুক্তভোগী পরিবার, স্থানীয় কৃষক এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সাক্ষাৎ করে মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করেন। এই পরিদর্শন, প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং ভুক্তভোগীর পরিবার, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরসহ অন্যান্যদের সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উঠে আসা প্রান্তিক কৃষকদের অসহনীয় বাস্তবতার চিত্র এই সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।

সম্মেলনে বক্তারা কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার দীর্ঘদিনের চিত্র এবং এর পেছনের কারণ হিসেবে ফড়িয়াবাজি, সিন্ডিকেট, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব, দুর্বল বিপণন ব্যবস্থা, নীতিনির্ধারকদের মনযোগের অভাব এবং এক্ষেত্রে সরকারি উদাসীনতাকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। আলোচনায় ধান ও চাল ব্যতীত অন্যান্য কৃষিপণ্য সরকারিভাবে সংগ্রহ না করা এবং খাদ্যশস্য সংগ্রহে বিদ্যমান অস্বচ্ছ পদ্ধতির কারণে কৃষকদের নিয়মিত প্রতারিত হওয়ার বিষয়টিতেও বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আত্মহত্যার শিকার কৃষক সাইফুল শেখের মেয়ে রোজেফা খাতুন ও মা রমেসা বেগম। এছাড়াও, খানির তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিনিধিসহ অন্যান্যদের মধ্য উপস্থিত ছিলেন খানির সহসভাপতি রেজাউল করিম সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ও স্ট্যাটিটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশাহিদা সুলতানা, ইনসিডিন বাংলাদেশের মুশফিক সাব্বির, একশনএইড বাংলাদেশের ডেপুটি ম্যানেজার অমিত রঞ্জন দে, আজকের পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার সাইফুল মাসুম এবং পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক- প্রানের নির্বাহী প্রধান নুরুল আলম মাসুদ প্রমুখ। এই সংবাদ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেছেন খানির সভাপতি ও কৃষি বিজ্ঞানী ড. জয়নুল আবেদীন।

ড. মোশাহিদা সুলতানা বলেন, “সম্প্রতি সরকার যে সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে কৃষির বিষয় উঠে আসেনি। এমনকি এবার ধানের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার যে পরিমাণ ধান কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাও কেনেনি। কৃষকদের বঞ্চনা থেকে রক্ষা করতে আমাদের কি কি বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন তা চিহ্নিত করতে হবে এবং তা সংস্কারের আওতায় আনতে হবে।”

পেঁয়াজ চাষী সাইফুল শেখের মেয়ে রোজেফা খাতুন তার বাবার আত্মহত্যার কারণ হিসেবে চাষাবাদে আর্থিক ক্ষতির ফলে সৃষ্ট গভীর হতাশা ও মানসিক দুশ্চিন্তার কথা উল্লেখ করেন এবং এই ঘটনার পর তাদের পরিবারের চরম দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন।

রোজেফা খাতুন বলেন, “আমার বাবা বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থা ও সারের দোকান থেকে ঋণ নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। দুই বিঘা জমিতে চাষ করতে যেখানে আমার বাবার দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছিল, সেখানে তিনি বিক্রি করে পেয়েছিলেন মাত্র ৫৮ হাজার টাকা। শ্রমিকের খরচ দেওয়ার পর আর কত টাকাই থাকে? আমার বাবা প্রতি মণ পেঁয়াজ বিক্রি করেছিলেন ৬০০ টাকায় অথচ এখন বাজারে পেঁয়াজের দাম ২০০০ টাকা। আমার বাবার মতো কৃষকেরা যদি লোকসানের হতাশায় আত্মহত্যা করেন, তাহলে মানুষের মুখে খাবার তুলে দিবে কে?”

তিনি আরও বলেন, “আমার সরকারের কাছে অনুরোধ শ্রমিকের অধিকার কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করবেন। যেন আর কেউ তার বাবা না হারায়।”

খানি সভাপতি কৃষি বিজ্ঞানী ড. জয়নুল আবেদীন বলেন, “আমাদের দরকার এমন সংস্কার যেখানে উৎপাদক এবং ভোক্তা উভয়ই লাভবান হয়। এই সংস্কারের জন্য আমাদের দরকার একটি সামগ্রিক প্রচেষ্টা। তবে নেতৃত্বটা সরকারকেই দিতে হবে। আমরা হয়তো একটা কেস নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু আরও কত ঘটনা আছে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।”

উক্ত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত রেজাউল করিম সিদ্দিকী বলেন, “ফসল যখন কৃষকের ঘরে থাকে তখন এর দাম থাকে না, কিন্তু ফসল যখনই মহাজনের হাতে যায় তখনই দাম বেড়ে যায়। কৃষক যখন পেশা পরিবর্তন করে ভ্যান চালানো শুরু করে, তা কি আত্মহত্যা নয়?”

বাংলাদেশে কৃষি ঋণের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, “দেশে মসলা চাষে কৃষি ঋণে সুদের হার ৪%। কিন্তু কৃষকেরা জটিলতার ভয়ে ঋণদাতা সংস্থা থেকে এর চেয়েও বেশি সুদে ঋণ নিচ্ছে। আর এনজিও গুলোও মৌসুমি ঋণ না দিয়ে নিয়মিত ঋণ দেয়। এতে করে কৃষকেরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে।”
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক- খানি এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান এবং তাদের ন্যায্য অধিকার ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।