জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা এবং বসতবাড়ির কৃষিতে প্রাধান্য দিয়ে পুনর্বাসন

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

প্রফেসর ড. মো: হুমায়ুন কবিরঃ জলবায়ু পরিবর্তন সাম্প্রতিক বিশ্বে পরিবেশ বিষয়ক সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জলবায়ু হলো ভূ-পৃষ্ঠের কোন স্থানের ২৫-৩০ বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থা। এটি মূলত কোন স্থানের দীর্ঘদিনের বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, সূর্যালোক ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বাড়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন তরান্বিত হয়েছে ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিকর ধরনগুলোর মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অতি বন্যা, অতিরিক্ত বৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, দীর্ঘমেয়াদি খরা দেখা দিবে । সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের অভ্যন্তরে নদীগুলোতে লোনা পানি প্রবেশ, দেশে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোন এর তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। প্রাকৃতিক নানা কারণে জলবায়ু স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হলেও মূলত মানবসৃষ্ট কারন যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার, কল-কারখানা, যানবাহন থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস, কয়লা পোড়ানো, ইটভাটার ধোঁয়া, নির্বিচারে গাছ কাটা ইত্যাদি কারণেই জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তন হয়।

দিনদিন জলবায়ুর পরিবর্তন জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলায় তা সংশ্লিষ্টদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইপিসিসি (IPCC: Intergovernmental panel on climate change) এর জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক AR6 সিন্থেসিস রিপোর্ট ২০২৩ এ মূল যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে মানুষের কার্যক্রমের ফলে সৃষ্ট গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে ২০১১-২০২০ দশক সময়কালে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০ সময়কালের চেয়ে ১.১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তাপমাত্রা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী ব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও খরার তীব্রতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে কতগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে তার মধ্যে বন্যা অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বন্যার সরাসরি সম্পর্ক আছে। প্রথমত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে, বায়ুমণ্ডল উষ্ণ হয়, ফলে বেশি পরিমাণে জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডল ধারণ করে এবং একই সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়, এ অতিরিক্ত পরিমাণ পানি দ্রুততম সময়ে নিষ্কাশন খুব কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে তীব্র বন্যার সৃষ্টি হয়।

বন্যা সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বায়ুমন্ডল স্বাভাবিকের থেকে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হলে তা ৮.৪ শতাংশ বেশি আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে যা ভারী বৃষ্টিপাতের প্রধান কারন। দ্বিতীয়ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যায়, অধিক তাপমাত্রায় মেরু অঞ্চলের বরফগুলো গলতে শুরু করে, আইস ক্যাপ গুলো ভেঙে যায়, সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বেড়ে যায় ফলে পানির আয়তন বেড়ে যায়। তাই যখন নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়, সাইক্লোন বা হারিকেন হয় তখন শুরুতে এর গতিবেগ অনেক বেশি থাকে, বাতাসের গতিবেগের তীব্রতা বেশি থাকার ফলে বেশি পরিমাণ পানি স্থল ভাগে ঢুকে পড়ে এবং তিব্র বন্যা হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এ বছর জার্মানিতে বন্যার তীব্রতা আগের বছরের তুলনায় অনেকগুন বেশি হয়। কয়েক মাস আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভারি বৃষ্টিপাতে বন্যা দেখা দেয়। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বমতে, সেখানকার রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর সঙ্গে সম্পর্কিত।

আমরা বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রলয়ঙ্কারি বন্যা হতে দেখেছি। কিন্তু এবার বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলা বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর ও কুমিল্লা জেলায় প্রবল বন্যা দেখা দেয়, যা অতীতে কখনো ঘটে নাই। অধিক বৃষ্টিপাত, সমুদ্রে নিম্নচাপ, দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, নদী খাল দখল এর কারনে পানি নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হওয়া এবং তার উপর পার্শ্ববর্তী দেশের বাঁধের কপাট গুলো খুলে দেয়ায় অতিরিক্ত পানি যোগ হয়ে পানির প্রবাহ বেড়ে যায়, এতে বন্যার তিব্রতা বেড়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি শেরপুর ও ময়মসিংহ অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা তীব্র আকার ধারন করেছে। এর আগে আমরা সিলেট অঞ্চলের বন্যা দেখেছি। সব ঘটনার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে জড়িত।

বাংলাদেশে এবারের বন্যায় কৃষিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এ ক্ষতি মোকাবেলায় প্রথমে বসতবাড়িকে কেন্দ্র করে কৃষি পুনর্বাসন এর কাজ শুরু করতে হবে। কোন কোন এলাকায় বন্যার পানি কমতে শুরু করায় বসতবাড়ির আশেপাশের জায়গাগুলো আগে দৃশ্যমান হচ্ছে। এঅবস্থায় বসতবাড়ি কেন্দ্রিক কৃষিতে গুরুত্ব দিয়ে কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা ও আয় বাড়ানোর দিকে নজর দেয়ার জন্য জোরালো আহবান জানাই। এসময়ে তাদেরকে সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত ভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া খুবই জরুরী বলে মনে করছি ।

দুর্গতদের যেহেতু চারা উৎপাদনের সুযোগ নাই, তাই বাইরে থেকে তৈরি সবজির-চারা যেমন লাউ, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, সিম, টমেটো, মরিচ, বেগুন ইত্যাদির চারা পলিব্যাগে তৈরি করে তাদের সরবরাহ করে সহযোগিতা করতে হবে। সবজি- চারার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শাক ও সবজির বীজ সরবরাহ করা আবশ্যক। সবজির চারা গুলো বসতবাড়ির আঙিনায় এবং বসতবাড়ির আশেপাশে সব উপযোগী জায়গায় লাগাবে। অবস্থাভেদে চারা গুলোকে সরাসরি মাটিতে, বস্তায়, পলিথিন ব্যাগে, প্লাস্টিক ক্রেটে, মাটির চাড়িতে, কাঠের বাক্সে, কাটা ড্রামে, পুরনো টিনে অথবা কলার ভেলায় লাগানো যাবে। বাড়ির পাশে জলাবদ্ধ জমিতে যদি কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ আগাছা থাকে তবে ভাসমান বেড প্রস্তুত করেও সবজি লাগানো যেতে পারে।

এসময় বসতবাড়িতে স্বল্পমেয়াদি লাল শাক, পুঁইশাক, ডাটা শাক ইত্যাদি চাষ করা যেতে পারে। এবন্যায় যেহেতু ফসলের মাঠ, বসতবাড়ির ফলের গাছ, গবাদিপশু, হাঁসমুরগি, পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। তাই সবজি- চারা ও বীজের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ যেমন কাঁঠাল, আম, পেয়েরা, লেবু, জাম্বুরা গাছের চারা কৃষকদেরকে সরবরাহ করা যেতে পারে। বসতবাড়িতে লালনপালনের জন্য মুরগির বাচ্চা পুকুরের জন্য মাছের পোনা প্রদান করা যেতে পারে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজ ও নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাজ ইতোমধ্যে সবজি-চারা ও বীজ সরবরাহ কর্মসূচি, মুরগির বাচ্চা প্রদান কার্যক্রম শুরু করেছে। এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঢাকা ব্যাংক এর একটি পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ বিভিন্ন ধরনের সবজির চারা তৈরি করে বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করছে । ইতোমধ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য-এর মাধ্যমে সবজির চারা ও বীজ এর প্রথম চালান ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, কুমিল্লার উদ্দেশ্যে বিতরনের জন্য হস্তান্তর করা হয়। উদ্যানতত্ত্ব খামারে উৎপাদিত সবজি-চারা পরবর্তীতে ফেনী জেলার সোনাগাজী ও লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরে পাঠানো হয়। উদ্যানতত্ত্ব খামারে চারা তৈরির এ প্রক্রিয়া চলমান আছে এবং থাকবে।

লেখকঃ
উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা