বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

রোটারিয়ান ড. মো. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ:
ভূমিকাঃ
মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা অন্যতম। একজন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা না গেলে, তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তবে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বিগত কয়েক দশকে অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। নতুন হাসপাতাল, উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীদের মাধ্যমে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এক নতুন স্তরে পৌঁছেছে। ঢাকা চেম্বার অডিটোরিয়ামে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য খাতে বিদেশমুখিতা কমাতে দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি’ বিষয়ক সেমিনারে এ তথ্য উঠে আসে (ঢাকা পোস্ট, ২৩ নভেম্বর ২০২৪) যে স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেবা নিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে বছরে স্বাস্থ্য সেবায় বিদেশে প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা চলে যায়।

এছাড়া তথ্য উঠে আসে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ হাজার ৪৬১ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে, যার মধ্যে ১ হাজার ৮১০টি ঢাকা বিভাগে অবস্থিত, পাশাপাশি ৩৬টি স্পেশালাইজড হাসপাতালের মধ্যে ১৯টি ঢাকাতে অবস্থিত হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন উন্নত স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত ঢাকার উপর চাপ বাড়ছে। উন্নত স্বাস্থ্য সেবার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অবকাঠামোর স্বল্পতা, দক্ষ ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ানের অভাব, সরকারি হাসপাতালে সেবা প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা, উন্নত সেবার জন্য ইন্স্যুরেন্স কভারেজের অনুপস্থিতি প্রভৃতি অন্যতম কারণ।

স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান উন্নয়ন

গত এক দশকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের রোগীদের ভারতে কিংবা নেপালে যেতে হয়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা আধুনিক হয়েছে।

  1. উন্নত হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র: দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চমানের হাসপাতাল গড়ে উঠেছে।
  2. বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ: মেডিকেল শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
  3. বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা: ক্যান্সার, কার্ডিয়াক এবং নিউরো সার্জারির মতো জটিল চিকিৎসা এখন দেশেই সম্ভব।

 চ্যালেঞ্জ: পেশাগত দক্ষতার ঘাটতি

স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন হলেও পেশাগত দক্ষতার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।

  1. মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের অভাব: চিকিৎসক ও নার্সদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত।
  2. গবেষণার ঘাটতি: চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে গবেষণার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ ক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগ কম।
  3. বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সেবা মনোভাবের প্রয়োজন

স্বাস্থ্যসেবা এমন একটি ক্ষেত্র যা কেবল পেশাগত দক্ষতার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং সেবা প্রদানকারীর মানবিক ও যত্নশীল মনোভাবের উপরও নির্ভর করে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে সেবা মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সেবা মনোভাব কেন গুরুত্বপূর্ণ?

রোগীর আস্থা অর্জন: একজন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর সদয় ব্যবহার এবং রোগীর প্রতি যত্নশীল মনোভাব রোগীর মনে আস্থা তৈরি করে।

চিকিৎসার মানোন্নয়ন: শুধুমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি নয়, রোগীকে মানসিক সান্ত্বনা প্রদানও তাদের সুস্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

মানবিক মূল্যবোধ চর্চা: সেবা মনোভাব স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ দেয়, যা একটি শক্তিশালী সমাজ গঠনে সহায়ক।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবা খাত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও অনেক ক্ষেত্রেই সেবা মনোভাবের অভাব লক্ষ করা যায়।

রোগীদের অবহেলা: কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষ থেকে রোগীদের প্রতি অবহেলার অভিযোগ উঠে।

দায়িত্বহীন আচরণ: সময়মতো উপস্থিত না হওয়া, অপর্যাপ্ত যোগাযোগ, এবং অশালীন ব্যবহার সেবা খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

অনিরাপদ পরিবেশ: হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে অনেক সময় রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত যত্ন এবং মানসম্পন্ন পরিবেশ নিশ্চিত হয় না।

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার হলেও, বাংলাদেশের জনগণ এখনো উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে না। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা এখনো যথেষ্ট উন্নত নয় এবং সাশ্রয়ীও নয়। সাধারণত, উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়, যদিও তাদের ট্যাক্স ব্যবস্থা আমাদের তুলনায় অনেক উন্নত, যা দিয়ে তারা চিকিৎসা সেবা সহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান করে। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবার অনেক উন্নতি হয়েছে, তবে আধুনিকায়ন এবং রোগীর সেন্সেটিভ স্বাস্থ্য ডাটা সুরক্ষার সিস্টেম এখনো সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

সমাধানের পথ

স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

  1. প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা: নিয়মিত প্রশিক্ষণ আয়োজনের মাধ্যমে পেশাগত দক্ষতা বাড়ানো।
  2. গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি: চিকিৎসা খাতে গবেষণার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো।
  3. সেবা মনোভাব উন্নয়ন: স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে নৈতিক শিক্ষা চালু করা।

সেবা মনোভাব উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ

স্বাস্থ্যসেবায় সেবা মনোভাব উন্নয়নে কয়েকটি কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে:

নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণ

চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার উপর জোর দেওয়া উচিত।

প্রশিক্ষণ কর্মসূচি

স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিয়মিত সেবা মনোভাব উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণ চালু করা প্রয়োজন।

রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন

রোগীদের মতামত গ্রহণ এবং তাদের প্রতি স্বাস্থ্যকর্মীদের যত্নশীল আচরণ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়া।

প্রণোদনা ব্যবস্থা

সেবা মনোভাব প্রদর্শনে সফল চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য বিশেষ পুরস্কার ও স্বীকৃতি চালু করা।

সেবা মনোভাব পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা

হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে সেবা মনোভাব পর্যবেক্ষণের জন্য একটি নির্দিষ্ট কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

  1. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড: বৈশ্বিক মান অনুসরণ করে দেশের চিকিৎসাসেবা উন্নত করা।

উদ্যোক্তাদের ভূমিকা

স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

স্বাস্থ্য খাতের এই অগ্রগতি ধরে রাখা গেলে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

উপসংহার

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত বর্তমানে সম্ভাবনাময় অবস্থায় রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে পারি। এতে শুধু দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে না, বরং বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশকে একটি মডেল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সেবা মনোভাব এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি শুধুমাত্র রোগীদের সুস্থতা নিশ্চিত করে না, বরং সমাজে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি সেবা মনোভাবের বিকাশে গুরুত্ব দিতে হবে। সেবার প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেলে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী, মানবিক, এবং টেকসই হয়ে উঠবে।

লেখক: ডেপুটি চিফ ভেটেরিনারিয়ান, ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,  এবং সভাপতি (২০২৩-২৪), রোটারি ক্লাব অফ রাজশাহী সেন্ট্রাল; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বিএলএস), যুগ্ম নির্বাহী সম্পাদক (বাংলাদেশ লাইভস্টক জার্নাল; ISSN 2409-7691), সম্পাদক সুজন, (রাজশাহী মেট্রোপলিটন), সভাপতি, বিবিসিএফ, রাজশাহী ও  সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দলোন (বাপা), রাজশাহী।