তীব্র শীত ও কুয়াশা কৃষিতে ক্ষতির আশঙ্কা

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

সমীরণ বিশ্বাস: বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শীতকালে শীতের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা দুইই ক্রমাগত কমে চলছে। এতে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং ফলন হ্রাস পাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হবে। অতি ঠান্ডায় আলু ,পিয়াজ ,রসুন, আদা, হলুদ ইত্যাদি ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাবে। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে নষ্ট হবে বোরোর বীজতলা। নষ্ট হচ্ছে কৃষকের শিম, লাউ, করলা, মিষ্টি কুমড়া, আলু, শাকসবজিসহ বিভিন্ন কৃষি খেত।

মৌসুমের এ সময়ে মাঠে শীতকালীন ফসল আলু, টমেটো, বেগুন, মরিচ, সরিষা, শিমসহ বিভিন্ন জাতের সবজি রয়েছে। এছাড়া কোথাও কোথাও বোরোর বীজতলা রয়েছে আবার কোথাও বোরো চারা রোপণ করা হয়েছে। চলমান শৈত্য প্রবাহে বোরো বীজতলা ও রোপা ধানের কোল্ড ইনজুরি এবং আলুর লেটব্লাষ্টইট রোগে আক্রান্ত হবার দুশ্চিন্তায় কৃষক ও মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদরা। এ ধরনের আবহাওয়া গম উৎপাদনে সহায়ক হলেও বৃষ্টি নামলে ছত্রাকবাহী ‘ব্লাষ্ট’ রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৯-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে হ্রাস পেয়েছে। ফলে রোপা বোরোর বীজতলা এবং আলু নিয়ে কৃষকের দুঃশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। বোরো বীজ রোপন ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলেও বীজতলা নিয়ে কিছুটা দুঃশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। পাশাপাশি আলু নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে কৃষকের।

অপরদিকে, গত কয়েকটি বছর ছত্রাকবাহী ব্লাষ্ট রোগের কারণে সরকার কিছু এলাকায় গম আবাদ নিরুৎসাহিত করলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে ঝুকিতে পরেছে বোরোর বীজতলা। বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকনাশক ছিটিয়েও তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, উত্তর অঞ্চল সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। শস্যভাণ্ডারখ্যাত উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা তলানিতে নামতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বীজতলা মরে বোরোর চারা সংকট দেখা দেয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে। কৃষকরা বলছেন, তারা বীজতলায় ছত্রাকনাশক ছিটাচ্ছেন। কুয়াশার হাত থেকে চারা বাঁচাতে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকেও রাখছেন। তীব্র শীত-কুয়াশার কারণে বোরো নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শীত বেশি হলে বোরো বীজতলাতেও সমস্যা হয়।

শীতে বিশেষ করে কুয়াশা বাড়লে আলুর মড়ক দেখা দেয়। ‘আলুগাছ অতি ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না। তাই কুয়াশা ঝরলে আমাদের চিন্তা হয়। শুধু আলুই নয়, টমেটোর ক্ষেতেও মড়ক দেখা দেয়। কয়েক দিনের ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে বগুড়া, রাজশাহী ও জয়পুরহাটে আলু চাষিদের মধ্যে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। বিঘার পর বিঘা জমির আলুর পাতা কুঁকড়ে যাওয়াসহ পাতা ও কাণ্ড পচে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। চার দিন পর পর তাঁরা জমিতে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছেন। আলু রোপণের দেড় থেকে দুই মাস পর কাণ্ড ও পাতা এই রোগে আক্রান্ত হয় বলে জানিয়েছেন কৃষক ভাইয়েরা। লেট ব্লাইট বা মড়ক নামের এই পচন রোগ থেকে রক্ষা পেতে জমিতে সপ্তাহে অন্তত এক দিন ছত্রাক নাশক ছিটাতেই হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

সংশ্লিষ্টরা কৃষকরা বলছেন, কয়েকদিনে রংপুর অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেশ বেড়েছে। দিনের বড় অংশই কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকায় ক্ষেতে ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় ধানের চারা হলুদাভ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকের বীজতলায় চারা পোড়া ও ঝলসানো রোগও দেখা দিয়েছে। জমিতে ১০-১৫ দিন বয়সী চারাগুলো সাদা ও লালচে রং ধরে মারা যাচ্ছে্।

প্রচন্ড ঠান্ডা ও ঘনকুয়াশার কবল থেকে বোরো ধানের বীজতলার চারা রক্ষার জন্য এখন যা করা দরকার তার পরামর্শ প্রদান করা হলো:
প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় বীজতলা সেচের পানি দিয়ে ডুবিয়ে রাখতে হবে এবং পরদিন সকাল বেলায় পানি বের করে দিন। চারাগাছে সূর্যের রোদ লাগার ব্যবস্থা করতে হবে। বীজতলায় ২-৫ সেন্টিমিটার (০.৭৮ থেকে ২ ইঞ্চি) পানি রাখুন এবং মাঝে মাঝে জমে থাকা পানি বের করে পুনরায় নতুন পানি দিন। আপনার বোরো ধানের বীজতলা প্রতিদিন সকালে একবার পরিদর্শন করতে হবে। বীজতলার চারা যদি হলুদ হয়ে যায়, তাহলে প্রতি শতাংশ বীজতলার জন্য ২০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা দরকার এবং এতে হলুদ না কমলে, প্রতি শতাংশ বীজতলার জন্য ১০০ গ্রাম হারে জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

বীজতলা পাতা ঝলসানো রোগে আক্রামত্ম হলে সকাল বেলায় রশি টানা দিয়ে চারা থেকে কুয়াশার পানি ফেলে দিতে হবে এবং বীজতলায় প্রতি শতাংশের জন্য ৫০ গ্রাম হারে পটাশ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত ঠান্ডায় বীজতলায় ছাই ছিটিয়ে তাপমাত্রা ধরে রাখা যায়। কাজেই এ অবস্থায় বীজতলায় ছাই ছিটাতে পারেন। স্বচ্ছ পলিথিন আবৃত ধানের শুকনা বীজতলা তৈরি করা। বীজতলা থেকে চারা তোলার এক সপ্তাহ আগে অনুমোদিত হারে কীটনাশক ছিটাতে পারেন । এতে বীজতলার চারা পোকামাকড়ের আক্রমন থেকে রক্ষা পাবে। বিস্তারিত জানার জন্য আপনার নিকস্থ উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাথে অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগের করুন।

উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাগন বলেন, ‘শৈত্যপ্রবাহের সময় বাড়তি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তা না হলে এর প্রভাব সামগ্রিক বোরো উৎপাদনে পড়বে। মাঠপর্যায়ে শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব থেকে বাঁচতে বীজতলায় নলকূপের পানি দিয়ে তা ধরে রাখতে হবে। এছাড়া বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে। শিশির পড়লে তা ঝরিয়ে দিতে হবে। এরসঙ্গে ছত্রাকনাশক এবং প্রতিশতক জমিতে ২৮০ গ্রাম করে ইউরিয়া সার দিতে হবে বেলে নির্দেশনা প্রদান করেন।

আমাদের মতো দেশে যেখানে উষ্ণ আবহাওয়ার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া এবং তাপমাত্রার (গরম এবং শীত) অনাকাঙ্ক্ষিত ঘন ঘন পরিবর্তন বিভিন্ন বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত কারণে মাটির জৈব পদার্থ বেশি বিয়োজন হয়। তাই আমাদের মাটিতে সাড়ে তিন পার্সেন্ট জৈব পদার্থ থাকলেও হয়। বর্তমানে "আমরা দেখেছি যে, জমিতে জৈব পদার্থর পরিমাণ ২ শতাংশের নিচে এমনকি কোথাও কোথাও ১ শতাংশের নিচে রয়েছে। মাটির জৈব উপাদানকে মাটির প্রাণ বলে অভিহিত করেন বিজ্ঞানীরা। আবহাওয়ার এই যে ঘন ঘন অতিগরম এবং অতি শৈত্যপ্রবাহ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা, বৃষ্টিবাদল এসব কিছুই মাটির প্রাণ জৈবকার্বন শূন্য হওয়ার একটি বড় কারণ বলে মনে করেন পরিবেশ ও মাটি বিশেষজ্ঞগন।

অতিমাত্রায় শীতের পাশাপাশি অসময়ের বৃষ্টিতে কৃষক ভাইদের দূর্ভোগে পরে। এই অসময়ের তুমুল বর্ষনে অনেক কৃষক সর্বশান্ত হন। সবজি ফসলের চারা পুরোটাই মারা পড়ে। নতুন করে আবার চারা লাগাতে হয়। এরকম দুর্যোগে যদি গাছ টিকে যায় এই আশায়- আশা তার একমাত্র ভেলা। ফসল চাষে রবি মৌসুম, লাভের মৌসুম। বেশ খরচ করে তারা ফসল ফলায় লাভের মুখ দেখবে বলে। সেখানেই অতি শীত এক বড় ধাক্কা। কুমিল্লা, রংপুরের, বগুড়া,রাজশাহী, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও সিলেট এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায় অসময়ের বৃষ্টির এবং শৈত্য প্রবাহের শঙ্কায় কৃষক ভাইরা রয়েছেন চরম হতাশায়।

জানা যায় তাদের দূঃখ দূর্দশা আশা প্রত্যাশার কথা। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ার জন্য তারা কৃষকদের পাশে সচেষ্ট রয়েছেন। স্থানীয় কৃষি বিভাগ, কৃষক ভাইদের নিরাপদ ফসল চাষের জন্য সার্বিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।