খাদ্য হোক নিরাপদ, সুস্থ থাকুক জনগণ

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

রোটারিয়ান . মোঃ হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ:জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস ২০২৫ উপলক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে খাদ্য হোক নিরাপদ, সুস্থ থাকুক জনগণ। এটি শুধু একটি প্রতিপাদ্য নয়; বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। আমাদের সুস্থ জীবনধারণের জন্য নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। অথচ বাংলাদেশে আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করি, তা প্রস্তাবিত মানের চেয়ে অনেক কম। এর পাশাপাশি, যে খাদ্য গ্রহণ করছি, তার বিশুদ্ধতা ও নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যায়।

খাদ্যের নিরাপত্তা পুষ্টি চাহিদার বর্তমান চিত্র

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি ও প্রোটিন প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে, আমরা আমাদের দৈনিক চাহিদার তুলনায় অনেক কম পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করি। শুধু তাই নয়, আমাদের গ্রহণ করা খাদ্যদ্রব্য প্রায়ই কীটনাশক, রাসায়নিক পদার্থ ও অন্যান্য দূষিত উপাদানে পরিপূর্ণ থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

বাজারে মাংস, দুধ, শাক-সবজি থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের খাদ্যদ্রব্যেই ভেজাল ও দূষণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে, গরুর মাংসের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতার চেয়ে মূল্যের দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে, নিম্নমানের ও দূষিত মাংস সহজলভ্য হলেও নিরাপদ ও গুণগত মানসম্পন্ন মাংসের চাহিদা কম থাকে।

ভোক্তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা

আমাদের দেশে নিরাপদ খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (BLS) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদ ইতোমধ্যে উচ্চমানের ও স্বাস্থ্যকর মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অধিকাংশ ভোক্তা উচ্চমানের মাংসের মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং তুলনামূলক কম দামের নিম্নমানের মাংস কেনাকাটায় আগ্রহী থাকে।

প্রশ্ন হলো, বাজারে ১ কেজি বিশুদ্ধ গরুর মাংসের দাম এবং ১ কেজি ভেজালযুক্ত গরুর মাংসের দাম প্রায় কাছাকাছি হলেও কেন আমরা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রতি উদাসীন? আমাদের মানসিকতা এখনো পরিবর্তন হয়নি। অনেকেরই ধারণা, “নিরাপদ খাদ্য মানেই উচ্চমূল্যের খাদ্য,” যা সঠিক নয়। বরং, নিম্নমানের খাদ্য সস্তায় পাওয়ার কারণে দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায় এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

উৎপাদক ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

শুধু ভোক্তাদের নয়, আমাদের উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের চিন্তাভাবনারও পরিবর্তন দরকার। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী দ্রুত মুনাফা অর্জনের জন্য এক টাকা বিনিয়োগ করে দুই টাকা লাভ করতে চান। তারা স্বল্পসময়ে অধিক মুনাফা অর্জন করতে গিয়ে খাদ্যের মান বজায় রাখার বিষয়টি উপেক্ষা করেন।

অন্যদিকে, উচ্চমানের ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষক ও খামারিদেরও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে, তারা উচ্চমানের খাদ্য উৎপাদন করলেও সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারণে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারেন না। ফলে, তারা কম দামে খাদ্য উৎপাদন করতে বাধ্য হন, যা পরোক্ষভাবে খাদ্যের মান কমিয়ে দেয়।

সততার অভাব প্রতারণার চক্র

আমরা যদি অন্যকে প্রতারিত করি, তাহলে একসময় আমরাও প্রতারিত হবো। আজ যদি একজন ভোক্তাকে ভেজাল খাদ্য দেওয়া হয়, তাহলে কাল তিনিও একই সমস্যার শিকার হবেন। আমাদের এই প্রতারণার চক্র ভাঙতে হবে। নিরাপদ খাদ্যের প্রতি আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে এবং ধীরগতিতে হলেও ন্যায্য লাভ নিশ্চিত করতে হবে।

সমাধান কী?

১. সচেতনতা বৃদ্ধি: নিরাপদ খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
2. সঠিক মূল্য নির্ধারণ: উচ্চমানের খাদ্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করতে হবে, যাতে উৎপাদকরা উপযুক্ত মূল্য পান এবং ভোক্তারাও মানসম্মত খাবার গ্রহণ করতে পারেন।
৩. আইনের কঠোর প্রয়োগ: খাদ্যে ভেজাল বা অনিরাপদ উপাদান মেশানোর বিরুদ্ধে কঠোর আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. উৎপাদক-ভোক্তা পারস্পরিক সংযোগ: ভোক্তা এবং উৎপাদকদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ তৈরি করতে হবে, যাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে এবং ন্যায্য দাম নিশ্চিত হয়।
৫. ধীরলাভের মানসিকতা: ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভ থেকে বেরিয়ে এসে ধীরে ধীরে লাভবান হওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।

উপসংহার

নিরাপদ খাদ্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য। আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে খাদ্যের মানোন্নয়নের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। যদি আজ আমরা নিরাপদ খাদ্যের প্রতি সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যতে এর চরম মূল্য আমাদেরই দিতে হবে।

এখনই সময় মানসিকতার পরিবর্তন আনার। আসুন, আমরা সকলে মিলে শপথ করি—নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করবো, সুস্থ থাকবো, সুস্থ রাখবো

-লেখক: ডেপুটি চিফ ভেটেরিনারিয়ান, ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বি.এল.এস),  এবং সভাপতি (২০২৩-২৪), রোটারি ক্লাব অফ রাজশাহী সেন্ট্রাল;, যুগ্ম নির্বাহী সম্পাদক (বাংলাদেশ লাইভস্টক জার্নাল; ISSN 2409-7691), সভাপতি, বিবিসিএফ, রাজশাহী এবং সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), রাজশাহী ।