"আমনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বোরো উৎপাদনে করণীয় "

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

সমীরণ বিশ্বাস| দেশে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আমন মৌসুমে ধানের ফলন হয়েছিল ১ কোটি ৬৬ লাখ টনের বেশি। আমনে চলতি অর্থবছরে ১ কোটি ৬৮ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। কিন্তু বন্যার প্রভাবে ২০২৪ সালের আগস্ট ও অক্টোবর মাসে ভারী বৃষ্টিপাত ও নদীর পানি বৃদ্ধির অনাকাঙ্ক্ষিতো বন্যার কারণে দেশে প্রায় ১১ লক্ষ মেট্রিক টন ধান নষ্ট হয়ে যায়। তবে সাম্প্রতিক দুটি বন্যা এবার আমনের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। তাই ধানের ফলন গতবারের তুলনায় কমে ১ কোটি ৪০ লাখ টনে নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। এতে করে সরকার ৫ লক্ষ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় আমনের প্রায় দুই লাখ হেক্টর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। আবার অক্টোবরের শুরুর দিকে শেরপুর ও ময়মনসিংহের আকস্মিক বন্যায় প্রায় এক লাখ হেক্টর আমনের ফসলি জমি ক্ষতির শিকার হয়। সব মিলিয়ে এবার আবাদি এলাকা কমেছে প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর। এর ধারাবাহিকতায় আমনের উৎপাদন গতবারের চেয়ে কমে নেমে আসতে পারে ১ কোটি ৪০ লাখ টনে।

গত ১৬ থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা ভারী বর্ষণে সৃষ্ট স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের ২৩টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, নাটোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট এবং যশোর। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী ভয়াবহ এ বন্যায় আউশ, আমন ধান, শাকসবজি, আদা, হলুদ, ফলবাগান, মরিচ, পান, তরমুজ, পেপে, টমেটোসহ বিভিন্ন ফসলের ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২১৪ মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল যা একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ধানের উৎপাদনে।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বন্যার কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি আমনের আবাদ। আবার অনেক এলাকায় দেরিতে আবাদ করায় উৎপাদন কম হয়েছে। সামগ্রিক ফলন এবার ১ কোটি ৫৭ লাখ টনের বেশী পৌঁছার সম্ভাব হয় নাই । যদিও সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, ইউএসডিএ যেভাবে আশঙ্কা করা হয়েছিল তেমনটি কমে নাই । ডিএইর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যার প্রভাবে এবার আমনের উৎপাদন কিছুটা কমলেও ইউএসডিএ যেভাবে আশঙ্কা করছে, সে মাত্রায় কমেনি। উপরন্তু এবার ফলন ভালো হয়েছে। আর যেটুকু কমেছে তা আসন্ন বোরো মৌসুমে পুষিয়ে দেয়া সম্ভব।

২৪-২৫ অর্থবছরে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ:সরকার চলতি বছরে ৫০ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমি থেকে ২ কোটি ২৬ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সর্বোত্তম উৎপাদন অর্জনের জন্য ডিএই কৃষকদের বিআরআরআই-২৯ এর মতো উচ্চ ফলনশীল জাত চাষে উৎসাহিত করছে। ডিএই বলেন, ‘আমরা কৃষকদের বিভিন্ন মেগা জাতের যেমন বিআর-৮৯, ৯২ এবং বিআর-১০২ চাষ করার পরামর্শ দিচ্ছি যাতে, কৃষকরা উল্লেখযোগ্য উৎপাদন পেতে পারে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান, ৩৫ লাখ ৬১ হাজার ১২ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাত এবং ১৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের চাষ করা হবে।

 বোরো মৌসুমের আগে সামগ্রিকভাবে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার মজুদের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ডিএই’র উপ-পরিচালক (সার ব্যবস্থাপনা) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, দেশে বোরো মৌসুমের জন্য পর্যাপ্ত সার মজুদ রয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত, মাঠ পর্যায়ে বোরো এবং অন্যান্য শীত মৌসুমী ফসল চাষের জন্য সরকারের কাছে ১১ লাখ ৪ হাজার ৯০৮ মেট্রিক টন ইউরিয়া, ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৬৫ মেট্রিক টন ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ৪ লাখ ৮০ হাজার ৪৫৯ মেট্রিক টন ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) এবং ২ লাখ ৫৬ হাজার ২৩ মেট্রিক টন মিউরেট অফ পটাশের (এমওপি) মজুদ রয়েছে। গত বছর ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো উৎপাদন হয়েছিল ২ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন।

চলতি বোরো ধানের উৎপাদন নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি কৃষক, কৃষিবিদ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। বোরো ধানের উৎপাদন নিশ্চিতকরণে-

মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার নিশ্চিত করা: উচ্চফলনশীল (HYV) ও রোগ প্রতিরোধী জাতের বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীল জাত যেমন ব্রি-৮১, ব্রি-৮৯ ইত্যাদি প্রচলন বাড়ানো। কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বীজ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি করা।

সেচ ও পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা: পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সেচ খাল ও গভীর নলকূপ সচল রাখা। ভূগর্ভস্থ পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পানির অপচয় রোধ করা। আধুনিক সেচ পদ্ধতি (Alternate Wetting and Drying - AWD) প্রয়োগ করা

 সার ও কীটনাশকের পর্যাপ্ত সরবরাহ: ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও জিংকের সরবরাহ নিশ্চিত করা। সারের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাতে কৃষক সহজে পেতে পারে। পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

 আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা: আগাম বন্যা ও খরার পূর্বাভাস কৃষকদের কাছে পৌঁছানো। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় বোরো ধানের বিকল্প জাত চাষ করা। শৈত্যপ্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে উপযুক্ত সময়ে চারা রোপণ করা।

 কৃষি ঋণ ও প্রণোদনা প্রদান: ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও প্রণোদনা প্রদান। উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারি ভর্তুকি ও বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ।

 আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রশিক্ষণ: কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরামর্শ দেওয়া। মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নির্দিষ্ট মাত্রায় সার প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

 ধানের ন্যায্য মূল্য ও বিপণন নিশ্চিতকরণ: সরকারিভাবে ধানের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কৃষকদের সরাসরি বাজারে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া। কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত গুদাম ও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কৃষক, সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগই উৎপাদন বৃদ্ধির চাবিকাঠি।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।