রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নতুন দল গঠন-চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

ডক্টর এ.এইচ.এম সাদেকঃ ‘'জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)। নতুন রাজনৈতিক এই দলটিকে ঘিরে দেশের জনগন ও তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশার জায়গা কতটুকু পূরন হবে তার উপর নির্ভর করবে আগামীদিনের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের রূপরেখা। জাতি বিগত প্রায় দের দশক এক নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদী শাসনে পিষ্ট হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের চরম দেউলিয়াত্বপনা দেখেছে। ওয়ার্ল্ড অর্ডার যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা বিগত রেজিমের অপশাসন ভালোভাবে নেয়নি। এ অবস্থায় শাসন কাঠামোয় ও রাষ্ট্রযন্ত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরনে সুস্থধারার আরো রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে। যদি নতুন গঠিত দলগুলো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সুস্থধারা আনতে মুন্সিয়ানা দেখাতে পারে তবেই আসবে চমক।

অনেকে এ নতুন দলটিকে বর্তমানের ‘কিংস পার্টি’র আবির্ভাব হিসাবে দেখতে চান। বিষয়টি এমন হলে দেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরনে ব্যর্থ হবে। কারন কোন কিংস পার্টি দেশে জনপ্রিয় হয়নি, বরং জনতার কাতারে বা জনগনের দলে পরিনত হলে দলটি সমর্থন পাবে এবং ভবিষ্যতে আরও  ভালো করবে। 

রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক কোন নতুন কিছু নয়। বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তাদের প্রতিনিধিত্বশীল আচরণ ও শাসনযোগ্যতার ভারসাম্য পরম নয়। একদিকে আছে সমস্যার লড়াই অন্যদিকে অসম  প্রতিযোগিতা। 

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুস্থধারার আরো রাজনৈতিক দল কেন দরকার?

সুস্থ রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের গণতন্ত্রকে সহজ ও দায়িত্বশীল/সংবেদনশীল (accessible and responsive) করে তোলে। আরো বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার (Transparency , Accountability & Answering) সুযোগ তৈরি করবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল (stabilize democracy) করবে। ফলে ভোটাররা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটিয়ে নতুন দল নির্বাচনের সুযোগ পাবে।

রাজনৈতিক দলগুলো যখন রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে থাকে না, তখনই গনতন্ত্র সাফার করে এবং বাধাগ্রস্ত হয়। মূলত গনতান্ত্রিক লাইফলাইনের প্রধান অংশীদার হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত বিরোধীদল হচ্ছে সুস্থ রাজনীতি ও গনতন্ত্র সুসংহতকরণে অন্যতম উপসর্গ। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দলের মধ্যে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এখনো সফল নয়, অনেকক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সুস্থধারার যত নতুন রাজনৈতিক দল হবে তত রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সুসংহত হবে।

ক্ষমতা, সংগঠন এবং এজেন্ডা নির্ধারণ আধুনিক গণতন্ত্রের মূখ্য বৈশিষ্ট্য। ভালো দলগুলোর লক্ষ্য নির্ধারণ এমন হওয়া উচিত যে, উত্তম প্রতিনিধিত্বের (Representation) মাধ্যমে জাতিকে উন্নত শাসন উপহার দিতে পারবে। ভালো" মানে আরও মধ্যপন্থী, উদারপন্থী এবং দেশের স্বার্থে নিজেদের বুঝব্যবস্থায় আরও আপোষ-ভিত্তিক।

জনস্বার্থে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ও এর সুফল কিভাবে আরো শক্তিশালী করা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোকে গভীর মনোনিবেশ করতে হবে। যেহেতু বছরটি বাম্পার ইয়ার অব ভোটিং (ভোটের বাম্পার বছর) অর্থাৎ ভোটের বছর হওয়ায় ভোটের সাথে জনঅধিকার বিষয়ক প্রতিশ্রুতি পূরনের দায়বদ্ধতা রয়েছে। 

বাকশাল পরবর্তী বহুদলীয় রাজনৈতিক ধারায় ছন্দপতন ঘটে, গনতন্ত্রের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এদেশে বহুদলীয় গনতন্ত্রের রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বহুধা বিভক্ত জাতিকে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্মে তুলে দিয়েছিলেন। মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনমূখী ও গণমূখী, কল্যানকামী ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মানে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার পথ তৈরি করেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। 

সুতরাং নতুন রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানানোর মধ্যে বহুদলীয় গনতন্ত্রের রাজনৈতিক চর্চার সৌন্দর্য  বৃদ্ধি করবে। তরুনদের এ তারুণ্যের শক্তিকে দেশ গঠনের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। বরং এ প্লাটফর্মকে দেশপ্রেমিক শক্তি হিসাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা যেতে পারে এবং দেশ রক্ষায় আধিপত্য ও আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যের প্লাটফর্মে পরিনত করা যেতে পারে। রাজনৈতিক মতানৈক্য থাকবে, সমালোচনা থাকবে কিন্ত জাতীয় স্বার্থে ইস্পাত কঠিন ঐক্য ধরে রাখতে হবে। 

বিগত রেজিম ১৪, ১৮ ও ২৪ এ নির্বাচন নামে খেলা করেছে। ১৪ এর বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় অটোপাশ, ১৮ ব্যালটবাক্স স্টাফিং ও ২৪ এর আমি - ডামি নির্বাচন দেশকে বহিঃবিশ্বে দূর্বল ও ভঙ্গুর গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দলবিহীন একদলীয় শাসনের তকমা নিয়ে ইতিহাসের চূড়ান্ত পরিনতি গ্রহণ করেছে। একটি শক্তিশালী কার্যকর বিরোধীদল প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হওয়ার আওয়ামী রেজিমের পতন আরো ত্বরান্বিত করেছে। আওয়ামী রেজিমের কর্তৃত্ববাদী, অপশাসন ও নিষ্ঠুরতম জুলাই আগস্ট -২৪ হত্যাকান্ড গনতান্ত্রিক বহিঃবিশ্বেকে চরম নাখোশ করে ও তাদের অসন্তোষের রোষানলে পড়ে। ফলাফল হিসেবে কোথাও আশ্রয় প্রশ্রয় নিতে পারে নি একমাত্র ভারত ছাড়া।

সুতরাং ২০২৫ সাল যদি ভোটিং ইয়ার হয়, তাহলে রাজনৈতিক ক্যালকুলেশন খুব হিসাব করে করতে হবে। ব্রোড ম্যাজরিটি লিড পার্লামেন্ট না করে, একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধীদলসহ শক্তিশালী পার্লামেন্টেরী ব্যবস্থায় প্রবেশ করা ছাড়া কোন ভালো উপায় দেখছি না। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিএনপির জনমত ও ভোটব্যাংক অংকে সরকার গঠনে ব্রোড ম্যাজরিটি অর্জন করবে এমন সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে মনে হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বসহ উন্নয়ন অংশীদারগণ চাইবে একটি গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া উন্নয়ন ও কার্যকর সংসদ ব্যবস্থা। কার্যকর সংসদ ব্যবস্থার জন্য দরকার সংসদে কার্যকরি ও ফলপ্রসূ বিরোধী পক্ষ বা জোট। সংসদে এমন এক আমেজ বজায় রাখতে পারলে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অর্থবহ সংসদ হিসেবে গন্য হবে। এরশাদের জাতীয় পার্টির মতো গৃহপালিত বিরোধী দলে পশ্চিমা শক্তি সন্তুষ্ট থাকবে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট বিরোধী সকল প্লাটফর্ম তথা বৈষম্যবিরোধী প্লাটফর্ম, ডান, বাম সকলকে আস্থায় নিতে হবে।

সামনে নির্বাচন দেশের জন্য এসিড টেস্টসম একটি চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ ওতরানোর জন্য প্রয়োজন সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও ঐক্য। কোনভাবেই কোন ফাঁদে পা ফেলা ঠিক হবে না। তাছাড়া নির্বাচন বৈতরণী পার হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে বিষয়টি সামনে নির্বাচন দেশের জন্য এসিড টেস্টসম একটি চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও ঐক্য। কোনভাবেই কোন ফাঁদে পা ফেলা ঠিক হবে না। তাছাড়া নির্বাচন বৈতরণী পার হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে বিষয়টি এমন নয়, নির্বাচন পরবর্তী সামনে আরো চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে।

জাতির মুক্তি ঐক্যবদ্ধতার মধ্যে নিহিত। মাত্র ছয় সাত আগেও দেশের মানুষ দেখেছে বিগত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট রেজিম ক্ষমতার যৌবনে সুন্দরী কাকদের মতো চেঁচামেচি ও বর্ষায় কুমারী সাজা নদীদের মতো দাপাদাপি ও কুর্দনমূর্দন। ৫ আগস্টের পরে তা ইতিহাস। এটা কোন কেচ্ছা কাহিনি না, বাস্তবতার ঠাসায় ভরপুর। জলন্ত ও চাক্ষুষ ইবরত নেওয়ার মত নজির। 

৫ আগস্টের শিক্ষা - কোথায় থামতে হবে, কোথায় ছাড়তে হবে, কোথায় বাঁধতে হবে, কোথায় রাঁধতে হবে- এই গতি মতির জোশ যদি হুশ না থাকে, তবে বেহুঁশ জাতি কি বেহুদা হত্যাযজ্ঞের শিকার হলো, আওয়ামী বর্জনে অর্জন কি মাঠে মারা যাবে - এ প্রশ্ন প্রকট হচ্ছে ? এটা খুব বাজে বার্তা। 

সমালোচনা থাকবে ; সমালোচনার গঠনমুলক দিকও আছে। নেতিবাচক ও বন্দনাবাচক হতে পারে। দুটোই উপকারী। এতে উপকার ও সংশোধনের পথ বাতলে দেয়। ক্রীটিসিজম রাজনৈতিক বন্দোবস্তোর পথকে সুন্দর ও সুগম করে। কিন্তু কনফ্লিক্ট ও ক্ল্যাশ মসৃন রাজনৈতিক পথকে কন্টকময় ও বিষময় করে তুলে। রাষ্ট্রের লিকেজ ধরা পড়ে। ভালো গনতন্ত্রের জন্য এটি কোন সমাধান নয় - সমাধান - আলোচনা। 

আর আলোচনার ক্ষেত্রে সফলতার জন্য দরকার - 
Simplicity - সরলতা 
Patience - ধৈর্য 
Compassion - করুনা/দয়ামায়া/উদারতা। 

এমনিতেই বাংলাদেশ এখন এক কঠিন সময় পার করছে। দেশের আভ্যন্তরীন সমস্যার সাথে বহিঃষড়যন্ত্র দেশকে কঠিন বাঁকে ফেলে দিতে পারে। একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ যখন গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রবেশ করবে, তখন ভ্যালিড সমস্যাগুলো সমাধানের পথও অনেকটা সহজ হবে। সমস্যা সমাধানে তখন আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেটও থাকবে।

কিন্ত দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে কোন হানাহানি, সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপের কারনেও যেন দেশ পথ হারিয়ে না ফেলে, কোন গভীর খাদে না পড়ে যায় সেদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি। 

সেনাপ্রধানের বক্তব্য দেশ, জাতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অনেক অর্থবহ ইঙ্গিত রয়েছে। মনে রাখতে হবে আধিপত্যবাদী ও ভৌগোলিক ষড়যন্ত্র কিন্তু থেমে নেই। তখন সামাল দেওয়া কঠিন হবে। আগে ছোবল মারা থেকে দেশ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের রক্ষা করা শিখতে হবে। শান্তিশৃঙ্খলা ও গনতান্ত্রিক পরিবেশকে সুসংহত করতে হবে। 

আত্মঘাতী সংঘাত করার সময় এখন না। এমুহূর্তে  দেশ ও দেশের জনগণকে বাঁচানোর একমাত্র পথ ঐক্য। 
United We Stand - Divided We Fall.

লেখক পরিচিতি: ডেপুটি রেজিষ্ট্রার (একাডেমিক সেকশন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।