সমীরণ বিশ্বাস: ফসল ব্যবস্থাপনার বিবর্তন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের কৃষির বিভিন্ন দিককে আরও কার্যকর, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। নিচে তা আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করছি।
১. সবুজ বিপ্লব বা কৃষি বিপ্লব ১৯৬০। লক্ষ্য ছিলো খাদ্য ঘাটতি দূর করা। উন্নত জাতের বীজ (HYV), সার, কীটনাশক, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন। ফলে খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে, তবে পরিবেশ ও মাটির স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
২. সমন্বিত কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ (Integrated Pest Control, IPC) – ১৯৭০। লক্ষ্য ছিলো কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য সমন্বিত কৌশল ব্যবহার। রাসায়নিক, জৈবিক ও যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সম্মিলন। কীটনাশকের মাত্রা কমানো এবং পরিবেশ সংরক্ষণ।
৩. অর্থনৈতিক সীমার স্তর (Economic Threshold Level, ETL) – ১৯৭০। লক্ষ্য ছিলো কোন স্তরে কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত, তা নির্ধারণ। পোকামাকড়ের সংখ্যা যদি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে, তবে তখনই কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয়।
৪. সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management, IPM) – ১৯৮০। লক্ষ্য ছিলো দীর্ঘমেয়াদি পোকা নিয়ন্ত্রণের টেকসই উপায়। IPM-এ ব্যবহৃত হয়, জৈবিক নিয়ন্ত্রণ (প্রাকৃতিক শত্রু), যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ (ফাঁদ), সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ (ফসল চক্র), রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ (শেষ উপায় হিসেবে), পরিবেশবান্ধব ও স্বল্প ব্যয়ে ফসল সুরক্ষা।
৫. সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা (Integrated Crop Management, ICM) – ২০০০। লক্ষ্য ছিলো ফসল উৎপাদনের সব উপাদানের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা। জমি প্রস্তুতি, সেচ, সার, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ, ফসল নির্বাচন ইত্যাদির সমন্বিত ব্যবহার। উৎপাদন বৃদ্ধি ও টেকসই কৃষি।
৬. উত্তম কৃষি চর্চ্চা (Good Agricultural Practices, GAP) – ২০২২। লক্ষ্য ছিলো নিরাপদ খাদ্য, কৃষকের নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণ। নিরাপদ কীটনাশক ব্যবহার, পানি ও মাটির সঠিক ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কৃষি। এটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত কৃষিপণ্য উৎপাদনের মাপকাঠি।
৭. সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা ব্যবস্থাপনা (Integrated Farming System Management, IFSM) – ২০২৪। লক্ষ্য ছিলো কৃষি, পশুপালন, মৎস্য, বনায়ন ইত্যাদির সমন্বিত ব্যবস্থাপনা। উপার্জনের বিভিন্ন উৎস সৃষ্টি। পরিবেশবান্ধব ও ঝুঁকিহ্রাসকারী কৃষি। কৃষকের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
ফসল ব্যবস্থাপনার এই বিবর্তন কৃষিকে শুধু খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ, পরিবেশবান্ধব, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা আনার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলেছে।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।