বাংলাদেশ; রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

ড. এম মনির উদ্দিন: ইডিজিএআর (ইমিউশনস ডাটাবেজ ফর গ্লোবাল অ্যাটমোস্ফেরিক রিসার্স) এর ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী গ্লোবাল গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমান মোট ৫৩ বিলিয়ন টন। চীন, মার্কিন যুক্তরাস্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ, রাশিয়া এবং ব্রাজিল একত্রে ২০২২ সালে বিশ্বের বৃহত্তম গ্রীণ হাউজ গ্যাস নিঃসরণকারী। এই দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫০.১ শতাংশ, বৈশ্বিক দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬১.২ শতাংশ, বৈশ্বিক জীবাস্ম জালানী খরচের ৬৩.৪ শতাংশ এবং বৈশ্বিক গ্রীণ হাউজ গ্যাস নির্গমনের ৬১.৬ শতাংশ করে থাকে। বিশ্বের ১৫২টি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ মিলে প্রতিবছর কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে মাত্র ১৭.৭ শতাংশ যা দেশ প্রতি গড়ে ০.১১ শতাংশ। অথচ এই দরিদ্র দেশগুলোকেই আজকে লড়তে হচ্ছে জলবায়ুগত পরিবর্তনের রোষানলে পড়ে যার মধ্যে বাংলাদেশ মারাত্মক ঝুকির মধ্যে থাকা সপ্তম দেশ।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, বিগত ১০০ বছরে পৃথিবীর বায়ূমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়েছে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। অনেক বিজ্ঞানী বলছেন ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়বে ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস আর সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে অর্ধ মিটার। আমাদের দেশটি এমন একটি অবস্থানে রয়েছে যার একদিকে সমুদ্র আর আরেক দিকে হিমালয়। এ অবস্থায় পৃথিবী যতই গরম হচ্ছে সমুদ্র ততই ফুলে উঠছে। আর বিশ্বের মানচিত্র থেকে বাংলাদেশের মুছে যাওয়ার শংকা ততই ঘনীভুত হচ্ছে। বিশ্বের তাপমাত্রা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যে হারে বাড়ছে তাতে আইপিসিসি’র তথ্য অনুসারে ২০৫০ সাল নাগাদ উপকুলীয় ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে যার কারনে জলবায়ু উদ্ভাস্তুর সংখ্যা দাড়াবে ১৩.৩ থেকে ১৯.৯ মিলিয়ন। আর এ জন্যই ব্রিটিশ সাংবাদিক জোহান হ্যারি জাতিসংঘের জলবায়ূ পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক পরিষদ (আইপিসিসি) এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশকে এভাবেই দেখেছেন: বাংলাদেশ; ১৯৭১ থেকে ২০৭১, ”রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”।

গবেষণায় বলা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে ১০ থেকে ১৫ ভাগ যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ২০৪০ সালের মধ্যে উপকুলীয় অঞ্চলে ১৮ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য এলাকায় ৭ শতাংশ আবাদী জমি কমে যাবে। লবনাক্ততা বর্তমানে উপকুলীয় এলাকার ৬২ শতাংশ জমিকে প্রভাবিত করছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে লবনাক্ততার অনুপ্রবেশ ৮ কিলোমিটার উত্তরে অগ্রসর হওয়ার পুর্বাভাস দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের মুল জাতীয় উৎপাদন বিশেষ করে ধান ও গমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমন ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে যার প্রভাবে দেশের মোট আয়তনের ১৮.৩ শতাংশ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে।

একসময় এ দেশের মানুষ পানি পান করার জন্য নদী, পুকুর, খাল, বিলের পানিই ব্যবহার করতো কিন্তু তা আজ অনেকটাই ইতিহাস। কিন্তু, ব্যতিক্রম দেশের দক্ষিন পশ্চিম উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষের ক্ষেত্রে যারা আজও রান্না, গৃহস্থালী কাজ এবং খাবারের জন্য পুকুর, ডোবার পানি ব্যবহার করছে। ঘুর্নিঝড় সিডর অত্র এলাকায় আঘাত হেনেছিল ২০০৭ সালে আর আইলা ২০০৯ সালে। মাঝে আরো কয়েকটি মাঝারী ধরনের ঘুর্ণিঝড়ও হয়েছে এসব এলাকায়। তবে, এলাকাবাসীর তথ্যমতে সিডর এবং আইলার ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ বা পোল্ডার এখনো মেরামত হয়নি। ফলে, সাধারন ঘুর্ণিঝড় বা জলোচ্ছাসে বাঁধের ভিতরের জমিতে লবনাক্ত পানি ঢুকে যায় যার ফলে ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। ১৯৭৩ সনে দেশের লবনাক্ত জমির পরিমাণ ছিল দশমিক ৮৩ মিলিয়ন হেক্টর যা এভাবেই বাড়তে বাড়তে বর্তমানে এসে দাড়িয়েছে ১ দশমিক শূন্য ১ মিলিয়ন হেক্টরে।

সাতক্ষীরা, খুলনা এবং বাগেরহাটের দক্ষিন পশ্চিম উপকুলীয় জেলাগুলিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন ঘুর্ণিঝড়ের কারনে লবনাক্ততার অনুপ্রবেশ স্বাদুপানির অভাবকে বাড়িয়ে তুলেছে। এই এলাকার মানুষের বসতবাড়ীর চারপাশে পানি আর পানি। তবে, বিশুদ্ধ মিঠা পানি পান করার নেই কোন উৎস একমাত্র মৌসুমভিত্তিক কিছু পুকুর ডোবা ছাড়া। ঐতিহ্যগতভাবে পানি সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা মহিলারা এখনও শারীরিকভাবে কঠিন এবং ঝুকিপুর্ন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দুরত্ব (প্রায়শই ২-৫ কিলোমিটার) হেটে যান। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মংলা (বাগেরহাট) ৬২.৯% এবং শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) ৭৮.১% মহিলাই একমাত্র পানি সংগ্রহকারী। এলাকার সকল মানুষ পান করে পুকুরের পানি তাও যখন শুস্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায় তখন এরা যেন চাতক পাখির মতো এক ফোটা খাবার পানির জন্য আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে। কিছু এলাকায় ভু-গর্ভস্থ পানি পাওয়া গেলেও তার জন্য কমপক্ষে ৮০০ ফুট গভীরে পাইপ স্থাপন করতে হয় তারপরও সে পানিতে লবনাক্ততার পরিমান গ্রহনযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশী। শুস্ক মৌসুমে স্বাদু পানির উৎস কমে যাওয়ায় মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুর প্রয়োজনীয় পানির সংকট তীব্র হয়।

স্বাস্থ্যের পরিস্থিতিও সমানভাবে উদ্বেগজনক। দীর্ঘস্থায়ী লবনাক্ত পানির সংম্পর্শে আসার ফলে মহিলাদের প্রজননতন্ত্রের সংক্রমন (মংলায় ৬৪.৮%, শ্যামনগর ৫৩.৮%), গর্ভাবস্থাজনিত উচ্চ রক্তচাপ এবং গর্ভপাত সমস্যা হচ্ছে। চিংড়ি ঘেরে লোনা পানিতে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে কাজ করার ফলে মহিলাদের চর্মরোগ (৯২.৩%) এবং মুত্রনালীর সংক্রমন দেখা যাচ্ছে। চিংড়ি ঘেরে নিয়মিত কাজ করতে গিয়ে কিশোরী থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলারা তাদের মাসিক ঋতু¯্রাব বন্ধ রাখার জন্য বিভিন্ন ঔষধ গ্রহন করছে যা তাদের স্বাস্থ্যঝুকিকে বাড়িয়ে তুলছে।

বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এবং খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেলো চিংড়ি চাষের ঘের। কথা হলো পাশ্ববর্তী এলাকার কৃষকদের সাথে এবং তারা জানালেন যে, অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ায় বর্ষাকালে ঘেরগুলোতে লবনাক্ততা কম থাকায় চিংড়ি চাষে ফলন পাওয়া যাচ্ছেনা এবং মোটেই তাদের জন্য লাভজনক হচ্ছেনা। পক্ষান্তরে, তারা রবি মৌসুমে এই ঘেরগুলিতে চিংড়ি চাষ না করে বোরো ধান চাষে বেশী আগ্রহী। তবে, প্রভাবশালী ঘের মালিকদের চাপে সাধারন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ধান চাষ করতে পারেনা। তাদের মতে, হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করলে ঘেরের জমিতে বিঘায় ৩০-৩৫ মন ফলন পাওয়া যায় যা তাদের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খুবই প্রয়োজন।

কৃষকদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে জানা যায়, শুস্ক মৌসুমে বিশেষ করে সাতক্ষীরার কয়েকটি উপজেলায় বিপুল পরিমান জমিতে পানি থাকেনা বা সেচ দেয়ার সুযোগ নেই সেখানে বোরো, গম, জোয়ার, চীনা, কাউন এবং অন্যান্য শুস্ক মৌসুমের ফসল চাষ করার সুযোগ রয়েছে যদি জমির পাশ দিয়ে খাল খনন বা জমির একপাশে মিনি পুকুর করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষন করা যায়। তবে, কৃষকদের মতে, তাদের কাছে সরকারী কোন অফিস বিশেষ করে কৃষি বিভাগের কোন কর্মী কোন পরামর্শ বা সহযোগীতার জন্য যায় না। তাদের মতে, উপযুক্ত পরামর্শ পেলে এই অবহেলিত অঞ্চলে বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসল চাষের মাধ্যমে এই অবহেলিত জনপদের নি¤œ আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর এলাকায় পরিকল্পিতভাবে তাল ও খেজুর গাছ লাগানোর বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে যা থেকে পুষ্টি সমৃদ্ধ তালের কাঁচা ও পাকা ফল, খেজুরের ফল সেইসাথে স্থায়ী গুড় শিল্প গড়ে উঠতে পারে। গোলপাতার ফলকে ঘিরেও গুড় তৈরীর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। এই অঞ্চলের শিক্ষিত বেকার যুবকদের প্রশিক্ষন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে জলবায়ু বান্ধব অনেক ফল জাতীয় গাছের বাগান সৃজন বিশেষ করে আম, আমড়া, আমলকি, সফেদা, কদবেল, বিলাতী গাব, বড়ই ইত্যাদির সমন্বয়ে বাগান তৈরীর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ করা যায় যা এই অঞ্চলের মানুষের সার্বিক পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে। একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, দেশের সমতলের অনেক ঔষধি গাছসহ অন্যান্য প্রজাতির গাছ যা অনেকাংশে বিলুপ্ত তবে এই অঞ্চলে রয়েছে সেইসব গাছের সমারহ যা এই অঞ্চলের ইকো-সিস্টেমকে এখনো বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে রেখেছে।

উপকুলীয় জনগোষ্ঠীর দুরাবস্থা দুর করে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান, মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য সরকারকে এই অঞ্চলকে ঘিরে দীর্র্ঘমেয়াদী কার্যক্রম গ্রহন করা জরুরীভাবে প্রয়োজন। দেশের এই উপকুলীয় অঞ্চলকে রক্ষার জন্য স্থায়ী পাকা বাঁধ নির্মান করা জরুরী। কারন, এই ধরনের কোন পদক্ষেপ এখনই গ্রহন করতে না পারলে দিন দিন সমুদ্রের পানিতে জমি হারিয়ে জলবায়ু উদ্ভাস্তুর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকবে যাদের পুনর্বাসন করা এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ভবিষ্যতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশের উপকুলীয় এই অঞ্চলের দুরাবস্থার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনই একমাত্র দায়ী। আর, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে যে শীর্ষ দেশগুলো সবচেয়ে বেশী দায়ী তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে। কারন, বাংলাদেশ বছরে যে পরিমান কার্বন নিঃসরন করে তা নিতান্তই সামান্য অথচ জলবায়ুর ঝুকিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশী ঝুকিপুর্ন। ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতির কারন হতে পারে। তাই, বেশী কার্বন নিঃসরনকারী দেশগুলি কর্তৃক বাংলাদেশের প্রতি জলবায়ুর ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং বাংলাদেশের জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রতিবছর প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে বাংলাদেশ বর্তমান ক্ষতিকে প্রশমিত করার পাশাপাশি উপকুলীয় অঞ্চলকে রক্ষার জন্য স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারে। বাংলাদেশ জলবায়ু ন্যায়বিচার সেইসাথে দাতাগোষ্ঠীর সহযোগীতা পেলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবকে মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহন করতে পারবে।

লেখকঃ প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, গেইন বাংলাদেশ