কৃষিভিত্তিক শিল্পের অভাবে, বঞ্চিত কৃষক

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

সমীরণ বিশ্বাস: বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং খাদ্য নিরাপত্তার বড় অংশই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও দেশে পর্যাপ্ত কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান, আধুনিক রাইসমিল, হিমাগার এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে ওঠেনি। এর ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং কৃষি খাতের সম্ভাবনা পূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

কৃষি উৎপাদনের চিত্র: বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে: ধান ও চাল: বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩৫০–৩৮০ লাখ মেট্রিক টন। সবজি: বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, বছরে ৬.৫ থেকে ১৯ মিলিয়ন টন সবজি উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয়-সর্বোচ্চ সবজি উৎপাদক দেশ। ফল: প্রতিবছর প্রায় ১৪.৮ মিলিয়ন টন ফল উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে কলা, আম, কাঠাল, পেয়ারা, অনারস ইত্যাদি। মৎস্য: ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে ৫০.১৮ লাখ মেট্রিক টন, যার মধ্যে ইলিশ উৎপাদন ছিল ৫.২৯ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে।

শিল্প প্রতিষ্ঠানের অভাব: বিপুল উৎপাদনের বিপরীতে, দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি পর্যাপ্ত: আধুনিক রাইসমিল ও শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র। হিমাগার ও কোল্ড চেইন অবকাঠামো ।ফল ও সবজি  প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প । মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান। ফলে কৃষকরা বাধ্য হন মৌসুমি দামে পণ্য বিক্রি করতে, যা তাদের আয়কে অনিশ্চিত করে তোলে। অনেক সময় অতিরিক্ত উৎপাদনেও বাজারে দাম পড়ে যায়, কারণ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ নেই।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব: কৃষকের আয় কমে যায়, ফলে তারা কৃষিকাজে আগ্রহ হারায়। বেকারত্ব বাড়ে, কারণ কৃষিভিত্তিক শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না। রপ্তানি সম্ভাবনা নষ্ট হয়, কারণ আন্তর্জাতিক মানের প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি হয় না।

করণীয় ও সম্ভাবনা: বাংলাদেশের কৃষি খাতকে শিল্পায়নের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ কৃষিভিত্তিক শিল্পে উৎসাহিত করা । প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন। কৃষক প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ উন্নয়ন। রপ্তানি ভিত্তিক কৃষি শিল্প গড়ে তোলা। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বিশ্বমানের হলেও, এর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে কৃষি ভিত্তিক শিল্পায়ন অপরিহার্য। স্বাধীনতা পরবর্তী এপর্যন্ত তেমন কোনো রকম কৃষিভিত্তিক কলকারখানা, সবজি ও ফল সংরক্ষণে হিমাগার , কৃষিশিল্প ভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন, এসব নিয়ে তেমন কিছু দৃশ্যমান কৃষক বান্ধব কার্যক্রম হাতে নেয় নাই বিগত দিনের সরকার গুলি। পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ , হিমাগার স্থাপন ও পণ্য পরিবহনের সুবিধা না থাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠে নাই বলে মত প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা। আন্ত:জেলার সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা কৃষিবান্ধব করা না গেলে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা হবে না বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষকরা।  কৃষি খাতে সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা না গেলে, টেকসই কৃষি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠবে না এবং সেই সাথে কৃষকের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

কৃষিভিত্তিক শিল্পের অভাবে আমাদের কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হয় না, ফসলের যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের সুযোগ সীমিত থাকে, ফলে তারা মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে কৃষকের পরিশ্রমের সঠিক মূল্য তারা পায় না এবং গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নতির সুযোগ হারায়। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা হলে শুধু কৃষকের জীবনমান উন্নত হবে না, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও টেকসই হবে।

লেখক:কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।