আতিকুল ইসলাম: বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় আবহাওয়া পূর্বাভাসের গুরুত্ব দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিবৃষ্টি, তাপপ্রবাহ ও শৈতপ্রবাহের মতো অনিশ্চিত আবহাওয়া কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। এই প্রেক্ষাপটে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস কৃষকের কাছে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষকেরা এই পূর্বাভাস কিভাবে গ্রহণ করছেন, কতটা বিশ্বাস করছেন এবং কীভাবে তা কাজে লাগাচ্ছেন তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মতামত ও অভিজ্ঞতা।
আবহাওয়া পূর্বাভাসের গুরুত্ব কৃষকের উপলব্ধি
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার কৃষক আব্দুল ওহাব বলেন, “আগে আমরা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে চাষাবাদের সময় ঠিক করতাম। কিন্তু এখন আবহাওয়া এত অনিশ্চিত যে শুধু অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করা যায় না। আবহাওয়া অফিস থেকে মোবাইলে যে বার্তা আসে, তা অনেক সময় ফসল রক্ষা করতে সাহায্য করে।” একই জেলার অন্য এক কৃষক, আনেছ মিয়া জানান, আমন মৌসুমে আবহাওয়া পূর্বাভাস থেকে বৃষ্টির সম্ভাবনা জেনে সেচের পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছেন, এতে তার খরচ কমেছে এবং ফলনও ভালো হয়েছে।বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃষকেরা যদি সময় মতো সঠিক পূর্বাভাস পান, তবে তা শুধু ফসলের ক্ষতি কমাবে না, বরং উৎপাদন খরচও হ্রাস করবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবহার করে চাষাবাদের সময়, সেচ, সার প্রয়োগ, কীটনাশক ব্যবহার এবং ফসল কাটার সময় ঠিক করা যায় যা সরাসরি উৎপাদন ও আয়ের উপর প্রভাব ফেলে।”
বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন
যদিও অনেক কৃষক আবহাওয়া পূর্বাভাসকে সহায়ক মনে করেন, তবে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দ্বিধাও আছে। গাইবান্ধার কৃষক লাল মিয়া বলেন,“সবসময় ঠিক হয় না। অনেক সময় পূর্বাভাসে বলা হয় বৃষ্টি হবে, কিন্তু হয় না; আবার বলা হয় হবে না, অথচ হয়। এতে আমরা বিভ্রান্ত হই।” বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূর্বাভাসের সঠিকতা বাড়াতে হলে স্থানীয় তথ্যের উপর ভিত্তি করে ক্ষুদ্র অঞ্চলের জন্য বিশেষায়িত পূর্বাভাস তৈরি করতে হবে। কারণ, দেশের এক অঞ্চলের আবহাওয়া অন্য অঞ্চলের থেকে ভিন্ন হতে পারে।
প্রাপ্তির মাধ্যম ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যৌথভাবে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করছে। বর্তমানে কৃষকেরা পূর্বাভাস পান
- মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে
- টেলিভিশন ও রেডিও সংবাদে
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে
- স্থানীয় কৃষি অফিসারের মাধ্যমে
তবে অনেক গ্রামীণ কৃষক এখনো স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না, ফলে তারা এসএমএস ছাড়া অন্যান্য মাধ্যমের পূর্বাভাস গ্রহণে পিছিয়ে থাকেন।
কৃষকের দৃষ্টিভঙ্গি সার্বিক চিত্র
একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে
- ৬৫% কৃষক মনে করেন, আবহাওয়া পূর্বাভাস তাদের ফসল ব্যবস্থাপনায় উপকারী ভূমিকা রাখে।
- ২০% কৃষক মাঝেমাঝে ব্যবহার করেন, কিন্তু পুরোপুরি নির্ভর করেন না।
- ১৫% কৃষক মনে করেন পূর্বাভাস যথেষ্ট নির্ভুল নয়, তাই তারা নিজের অভিজ্ঞতার উপরই নির্ভর করেন।
পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনার সাফল্যের গল্প
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার কৃষক সুলতান আহমেদ গত আমন মৌসুমে পূর্বাভাস পেয়ে আগাম ধান কেটে ফেলেন, ফলে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র ক্ষতির হাত থেকে ফসল রক্ষা করেন। তিনি বলেন,“আগে আমরা প্রকৃতির উপর ছেড়ে দিতাম, কিন্তু এখন প্রযুক্তির সাহায্যে ক্ষতি কমানো যা।”এই ধরনের সফল উদাহরণ কৃষকদের পূর্বাভাসে আস্থা বাড়াচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
১। পূর্বাভাসের সঠিকতা বৃদ্ধি – স্থানীয়কৃত পূর্বাভাস ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা জরুরি।
২। সচেতনতা বৃদ্ধি – কৃষকের মধ্যে পূর্বাভাসের গুরুত্ব ও ব্যবহার পদ্ধতি নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
৩। সহজলভ্যতা নিশ্চিত – প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকের কাছে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ডিজিটাল মাধ্যম সহজলভ্য করা দরকার।
৪। দ্বিমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা – কৃষক যেন মাঠের পরিস্থিতি জানিয়ে পূর্বাভাসকে আরও নির্ভুল করতে অবদান রাখতে পারেন।
উপসংহার
বাংলাদেশের কৃষিতে আবহাওয়া পূর্বাভাস শুধু একটি তথ্য নয়। এটি এখন কৃষি পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। তবে কৃষকের আস্থা অর্জন, প্রযুক্তির বিস্তার এবং স্থানীয়ভাবে উপযোগী পূর্বাভাস প্রদান না করা পর্যন্ত এর পূর্ণ সুফল মিলবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে পূর্বাভাসভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনা হতে পারে কৃষকের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।
লেখক: পিএইচডি ফেলো, শেরেবাংলা কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।