ড. হারুনুর রশীদ, ড. মোহাম্মদ মতিউর রহমান, ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক, ড. মোঃ জসিম উদ্দিন, ড. জোয়ার্দ্দার ফারুক আহমেদ
ভূমিকাঃ এবছর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদীর খসড়া তালিকা-২০২৫’ অনুযায়ী দেশের নদ-নদীর সংখ্যা ১২৯৪টি। তিব্বত, হিমালয়, মেঘালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে উৎসরিত ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তর থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের দিকে ধেয়ে চলা এসব নদী তার গতিপথে অসংখ্য অভ্যন্তরীণ জলাশয় তৈরি করেছে ও তাতে পাণ-প্রবাহ সৃষ্টি করেছে। ফলে এসব নদীর গতিপথের দু’পাড় জুড়ে রয়েছে অসংখ্য হাওর-বাওড়, বিল-ঝিল ও প্লাবনভূমি। এসব জলাধার মৎস্য সম্পদের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার; সেইসাথে বাংলার প্রাণবৈচিত্র্য ও অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলোর মৎস্য জীববৈচিত্র্য এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প, অবৈজ্ঞানিক নদী শাসন, ধ্বংসাত্মক মৎস্য আহরণ, ত্রুটিপূর্ণ ইজারা ব্যবস্থা, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং আইনি দুর্বলতার সম্মিলিত আঘাতে দেশের স্বাদুপানির অধিকাংশ মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রজাতির অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। বিশেষ করে নদী-জলাশয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা মাছের প্রাকৃতিক চলাচল ও প্রজনন চক্রকে ব্যাহত করছে, অন্যদিকে শিল্পবর্জ্য ও কৃষিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ জলজ বাস্তুতন্ত্রকে বিষাক্ত করে তুলছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ শুধু প্রজাতি বিলুপ্তিরই ইঙ্গিত দেয় না, সেইসাথে লক্ষাধিক মৎস্যজীবীর জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলজ সংস্কৃতির উপরও এক গভীর ছায়া ফেলেছে। এ বছর উদযাপিত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের (১৮ আগস্ট হতে ২৪ আগস্ট ২০২৫) “অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি” প্রতিপাদ্যের আলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মৎস্য জীববৈচিত্র্য হ্রাসের কিছু কারণ ও সমাধান নিচে আলোচনা করা হলো।
জলাশয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা (Habitat Fragmentation): বাংলাদেশের নদী-নালা, হাওর-বিল ও প্লাবনভূমিগুলো মিঠাপানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন অবকাঠামো (যেমন, অপরিকল্পিতভবে নির্মিত রাস্তা-ঘাট, বাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, ইত্যাদি) নির্মানের ফলে সৃষ্ট জলাশয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা (habitat fragmentation) আজ এই বাস্তুতন্ত্রের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ফলে নদীর সাথে খালের বা খালের সাথে বিলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে প্রতিনিয়ত; মাছের জীবনচক্র পূর্ণ করার জন্য আবশ্যকীয় চলাচল বা মাইগ্রেশন হয়েছে ব্যহত। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে উৎসারিত বরাক নদী থেকে উৎপন্ন সুরমা-কুশিয়ারা আমাদের হাওরের পানি সরবরাহের উল্লেখযোগ্য নদী; কিন্তু সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্প বা কুশিয়ারা নদীর বাঁধ নির্মাণের মতো প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকালে ফিশ পাস (fish pass) নির্মাণ বা মাছের চলাচলের কোন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত না করার এসব অবকাঠামো শেষ পর্যন্ত মাছের প্রাকৃতিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে ইলিশ, কার্প-সহ অন্যান্য পরিযায়ী মাছগুলো তাদের প্রজনন বা বিচরণ ক্ষেত্রে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা জীবনচক্রকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। একইভাবে, হাওর-সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের মত জেলায় জলজ জীববৈচিত্র্যের আলোকে হাওরের বুক চিরে রাস্তা নির্মাণেই যেখানে অনুচিত সেখানে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে এমনভাবে যাতে কালভর্টের সংখ্যা খুবই অপর্যাপ্ত। ফলে বিল-হাওয় যেমন বিভক্ত হয়েছে তেমনি বর্ষায় প্লাবনভূমি (floodplains) ও মূল নদীর মধ্যে সংযোগ ছিন্ন হয়েছে। এর প্রভাব গুরুতর – এই সংযোগ বিচ্ছিন্নতা মৎস্য জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক হুমকির তৈরি করছে। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ দেশের অসংখ্য নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও মাছের চলাচল ব্যাহত করছে, যার ফলে অধিকাংশ পরিযায়ী মাছের প্রজাতি তাদের প্রাকৃতিক প্রজননস্থলে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই বাঁধের কারণে এবং হালদা নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে রুই-কাতলা-সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও উৎপাদন ব্যপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। রাস্তার কারণে প্লাবনভূমিগুলো নিজেদের মধ্যে এবং পার্শবর্তী নদীর সাথে সংযুক্তি হারিয়েছে; যার ফলে মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর প্রাকৃতিক প্রজনন ব্যহত হচ্ছে যা একটি বাস্তুসংস্থানের উৎপাদনশীলতার জন্য একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ফলে উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি সমগ্র খাদ্য শৃঙ্খলকে বিপন্ন করে তুলছে।
নদী শাসন বা খননের নামে ভুল পদ্ধতির প্রয়োগও সংযোগ বিচ্ছিন্নতার অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রে নদী শাসনের নামে নদীর প্রাকৃতিক মোড় (meander) কেটে ফেলা হয়েছে, যার ফলে পানি প্রবাহ দ্রুত হলেও মাছের আবাসন ধ্বংস হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, হালদা নদীর কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের একটি কারণ হল নদীর বাঁক কেটে সোজা করা। নদীর বাঁকগুলো কার্প মাছের প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল এবং এই বাঁকগুলো কেটে ফেলার ফলে মাছের বিচরণ ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে, যা তাদের প্রজনন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে। এসব অপরিকল্পিত নদী শাসনের ফলে ছোট নদীগুলো মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। নোনা পনির প্রবেশ ঠেকাতে বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থায়নে ষাটের দশকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোস্টাল এমব্যাঙ্কমেন্ট প্রজেক্ট-এর মতো প্রকল্পের অধীনে বাঁধ নির্মাণ পানি চলাচলের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা (hydrological dysconnectivity) সৃষ্টি করে স্থায়ী জলাবদ্ধতা তৈরি করেছে, পক্ষান্তরে যে উদ্যেশ্যে এত টাকা ব্যয় করে এই প্রকল্প তা অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে। এধরণের প্রকল্পের ফলে সৃষ্ট সংযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে মাছের মাইগ্রেশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি আবাসস্থল সম্পুর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়েছে – উপকূলী জোয়ার ভাটা প্রভাবিত অল্প লবণাক্ত পানির জলাভূমি এখন মিঠাপানির বদ্ধ জলাশয়।
সমাধানের উপায়: প্রথমত: সংযোগ বিচ্ছিন্ন জলাশয়গুলোর মধ্যে মাছের চলাচলের সুযোগ করে দেয়া জরুরী, প্রয়োজনে মাছের মাইগ্রেশনের জন্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে কোন কাঠামোর ব্যবস্থা করা, যেমন - ফিশ পাস বা ইকো-ব্রিজের নির্মাণ, পুল-অ্যান্ড-ড্রপ ফিশওয়ে, ভার্টিক্যাল স্লট ফিশ পাস ও নেচার-লাইক বাইপাস চ্যানেল তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত: অপ্রয়োজনীয় বাঁধ অপসারণ ও প্রাকৃতিক খাল পুনঃখনন। যত্রতত্র নদী-খালের উপর অবৈধভাবে নির্মিত বাঁধ অপসারণ ও নদী-হাওর-প্লাবভূমির মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রয়োজনে মৃত খাল পুনঃখনন করা প্রয়োজন। এছাড়া, অবকাঠামো নির্মাণেও দরকার পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির অনুরণ। সচরাচর নির্মিত ’বক্স কালভার্ট’-এর বদলে ’আর্চ ব্রিজ’ নির্মাণ করে অধিক পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। কালভার্টের বা ফিশ পাস তৈরির সময় নিচে প্রাকৃতিক মোটা বালি, নুড়ি বা পাথর রাখলে মাছ চলাচলের সুবিধা হয়। নুড়ি-পাথর প্রাকৃতিক পৃষ্ঠতলের ঘর্ষণজনিত আঘাত কমায়, বিশেষত আঁইশ-বিহীন শিং-মাগুরের মতো প্রজাতির দেহে আঁচড় লাগার ঝুঁকি হ্রাস পায়। একইসাথে, নুড়ি-পাথর মাছের প্রবাহের দিকনির্ণয় ক্ষমতা (rheotaxis) উদ্দীপিত করে, যা বিশেষত: তলবাসী প্রজাতির মাছগুলোকে অভিযোজনে সাহায্য করে। এছাড়া নুড়ির ফাঁকে জন্মানো শৈবাল ও অণুজীব ক্ষুদ্র মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎস হিসেবে কাজ করে, ফলে কালভার্টটি একটি অস্থায়ী বাস্তু-করিডোরে পরিণত হয়। এছাড়া, নুড়ির ফাঁকে সৃষ্ট স্থিতিশীল পানির স্তর মাছকে শক্তি সঞ্চয় ও বিশ্রামের সুযোগ দেয়। মৎস্য আইনে সংশোধনী এনে সব জলকাঠামোতে ফিশ পাস বাধ্যতামূলক করা এবং পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্ত হিসেবে এটি যুক্ত করতে হবে। নদী রক্ষা কমিশনকে বিচ্ছিন্নভাবে পরিকল্পনা না করে ’হাইড্রোলজিক্যাল ইউনিট’-ভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষমতা দিলে নদীর সংযোগ রক্ষা কার্যকর হবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, জলাশয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা কেবল মাছের বৈচিত্র্য হ্রাসের বিষয় নয়, এটি সমগ্র জলবাস্তুতন্ত্রের উৎপাদনশীলতা টিকিয়ে রাখার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নদীগুলোর বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র পুনরুদ্ধারে সাফল্য প্রমাণ করে যে প্রকৌশলগত সঠিক নকশা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ একত্রিত করলে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।
ধ্বংসাত্মক মৎস্য আহরণ পদ্ধতি (Destructive Fishing): বাংলাদেশের নদী-হাওর-বিলের প্রাকৃতিক মৎস্য ভাণ্ডার আজ ধ্বংসাত্মক আহরণ পদ্ধতির মুখে অস্তিত্বসংকটে পড়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, শুধুমাত্র কারেন্ট জালের ব্যবহারেই প্রতি বছর ইলিশ পোনার একটি বড় অংশ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, যা ইলিশের সামগ্রিক উৎপাদনকে ব্যহত করছে। এছাড়া, অবৈধভাবে কাঠের ছোট ট্রলারগুলোতে যান্ত্রিক ট্রলিং ব্যবস্থা সংযুক্ত করে বেহুন্দি জালের মত ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি আধা‑ইঞ্চি আকারের খুবই ছোট ফাঁসের জালের মাধ্যমে মা মাছ, মাছের ডিম ও পোনা, গুরত্বপূর্ণ প্রজনন-প্রকৃতি এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাথরঘাটা, মহিপুর, ভোলা ও চট্টগ্রামে শতাধিক ট্রলার এখন এভাবে মাছ শিকার করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে উপকূলীয় বাস্তুসংস্থান ও মৎস্যভান্ডার ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন করছে। যান্ত্রিক উইঞ্চ ও জিপিএস‑সহ এই রূপান্তরিত ’ট্রলার’গুলো ৬–৮ মিটার গভীরে চলে যায়, যেখানে সহজেই মা মাছ ও তাদের প্রজনন স্থানগুলোর ধ্বংস করছে। আইনি ফাঁকফোকর ও রিটের নিয়মের কারণে মৎস্য অধিদফতর এই কর্মকাণ্ড রুখে দিতে না পারায় পরিস্থিতি আরও জটিলতর হচ্ছে। আরও ভয়াবহ হলো রাসায়নিক বিষ প্রয়োগ: গাছের মূল থেকে প্রাপ্ত রোটেনন বা শিল্পজাত সায়ানাইড পানিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সক্রিয় থেকে সমগ্র জলজ জীবন নিধন করে। নদী-খালে বোমা মেরে মাছ ধরাও এখন নিয়মিত ঘটনা, যার বিস্ফোরণে মাছের বাসস্থান ও প্রজননের জন্য গুরুত্বপুর্ণ জলাশয়ের তলদেশ চিরতরে ধ্বংস হয়।
সমাধানের উপায়: এই সংকট মোকাবিলায় বহুমুখী কৌশল বাস্তবায়ন জরুরী। প্রথমত, আইন প্রয়োগে প্রযুক্তির সমন্বয় করে প্রয়োজনবোধে জিপিএস ও ড্রোন সার্ভিল্যান্স-এর মাধ্যমে অবৈধ মাছ ধরা শনাক্ত করতে হবে। মৎস্য আইনের ধারা পরিবর্তন করে, প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে, ও সেসব ধারা কঠোরভাবে প্রয়োগ করে সকল ধরণের অবৈধ ও ক্ষতিকর জাল ব্যবহার উদ্যোগ নেয়া জরুরী। অনেক সময়, জেলেদের জীবিকার রূপান্তর বা বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিও ভাল ফলাফল দিতে পারে। টাঙ্গুয়া-হাকালুকি হাওর এলাকায় সরকারী-বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে জেলে সমবায় গঠন করে বিকল্প আয় সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়ার ফলে ধ্বংসাত্মক মৎস্য আহরণ অনেকাংশে কমতে দেখা গিয়েছে। অনেক সময় সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা (CBFM) সুফল দিতে পারে। টাঙ্গুয়া-হাকালুকি হাওরের মত ’রামসার সাইট’-এ সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা মডেল চালুর ফলে স্থানীয় জেলে, নারী ও যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত ’নদী পাহারাদার দল’ অবৈধ মাছধরা রিপোর্টিং ও অভয়াশ্রম রক্ষণাবেক্ষণের পদক্ষেপ নেয়াতে ধ্বংসাত্মক মৎস্য আহরণ পদ্ধতিগুলো কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে; ফলে মাছের প্রজাতির সংখ্যা ও জলজ জীববৈচিত্র বেড়েছে। এধরণের পদক্ষেপ দেশের অন্যান স্থানের অভ্যন্তরীন জলাশগুলোতেও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতেও ধ্বংসাত্মক মৎস্য আহরণ নিয়ন্ত্রণকল্পে ’প্রতিরোধ, প্রতিস্থাপন, পুনরুদ্ধার’ কৌশল অব্যাহত রাখতে হবে। ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি বন্ধ করে টেকসই আহরণ পদ্ধতি নিশ্চিত করতে পরলে পরে মাছ বাঁচবে, জেলে বাঁচবে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পাবে। টাঙ্গুয়ার হাওড় ও হাকালুকির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এই সংগ্রামের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
ত্রুটিপূর্ণ জলমহাল ব্যবস্থাপনা (Faulty Leasing System): বাংলাদেশের জলাশয় ব্যবস্থাপনায় জলমহাল ইজারা পদ্ধতির সুস্পষ্ট ত্রুটি মৎস্য জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুকনো মৌসুমে যখন জলাশয়ের পানি কমে যায় তখন প্রাকৃতিক জলাভূমির যে গভীর অংশগুলোতে মাছগুলো আশ্রয় নিয়ে থাকে সেসব ’শেষ আশ্রয়স্থল (last refuge)’ গুলোকেই সরকারে বিভিন্ন দপ্তর ’জলমহাল’ হিসাবে ইজারা প্রদান করে। সাধারণত: স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ইজারাদাররা মাছের এসব আশ্রয়স্থল শুকিয়ে সমস্ত মাছ ধরে ফেলে, যার ফলে ’মা মাছ’ নিধনের মাধ্যমে প্রজননক্ষম প্রজাতির জিনগত বৈচিত্র্য হ্রাস পায় এবং পরবর্তী মৌসূমে মাছের উৎপাদনশীলতার কমে যায়। এভাবে অসংখ্য স্থানীয় প্রজাতি মাছ বিলুপ্তির পথে চলে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এক্ষেত্রে ইজারা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এই সংকটকে তীব্রতর করেছে। নিলামের আগে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের নোটিফিকেশন না দেওয়া, এমনকি অফিসিয়াল রেকর্ড ছাড়া মৌখিক ইজারার মাধ্যমে জলাশয় ব্যবহারের অনুমতি দেয়র ঘটনাও ঘটেছে, যার খবর বিভিন্ন সময় পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো ইজারা দলিলে ’মাছের ন্যূনতম সাইজ’, ’অভয়াশ্রম ও মৎস্য প্রজাতি সংরক্ষণ’ বা ’প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা’ পালন সম্পর্কিত কোন শর্তের অনুপস্থিতি, যা টেকসই মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তিকেই উপেক্ষা করে।
সমাধানের উপায়: এই সংকট সমাধানে প্রথমত, ইজারা নীতিমালায় আমূল সংস্কার জরুরি। প্রতিটি জলাশয়ের জীববৈচিত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো চিহ্নিত করে স্থায়ী অভয়াশ্রম ঘোষণা করতে হবে, যেখানে ইজারা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হবে। ইজারার মেয়াদ বর্তমানে তিন বছর থেকে কমিয়ে ফেলতে হবে, যাতে নিয়ম লঙ্ঘন করলে তার দ্রুত প্রতিকার সম্ভব হয়। এসব জলামহাল আইনত: মৎস্যজীবী সমবায়কে ইজারা দেয়ার কথা থাকলেও বেনামে প্রভাবশালীরাই ইজারা নেয়; তাই প্রকৃত মৎস্যজীবী যাতে জলমহাল ইজারা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। শুকনো মৌসুমে জল ও জলা ব্যবস্থাপনায় বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। জলাশয়ের গভীর অংশগুলো চিহ্নিত করে সেখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করতে হবে; এক্ষেত্রে প্রয়োজনে আধুনি জিঅইএস ও জিপিএস পদ্ধতি প্রয়েগ করে ’জলাশয়ের সংরক্ষিত অঞ্চল’ ঘোষণা করে মাছের আশ্রয়স্থল সুরক্ষিত রাখতে হবে। একই সাথে জেলেদের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস সৃষ্টির লক্ষ্যে (যেমন, জলাশয় ভিত্তিক হাঁস পালনের প্রশিক্ষণ, জলজ উদ্ভিদ প্রক্রিয়াজাত করে জৈব সার উৎপাদন, ইত্যাদি) প্রকল্প হাতে নিতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল ইজারা ব্যবস্থা চালু করা অপরিহার্য। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ‘জলমহাল ড্যাশবোর্ড’ স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে ইজারার আবেদন, নিলামের তারিখ ও বিজয়ীর তথ্য প্রকাশিত হবে। প্রয়োজনে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জেলেরা যাতে ছবি ও জিপিএস লোকেশন-সহ অবৈধ দখল রিপোর্ট করতে পারবেন তার ব্যবস্থা নেয়া যায়। স্বচ্ছতা নিশ্চিৎকল্পে ব্লকচেইন টেকনোলজি ব্যবহার করে ইজারা লেনদেনের রেকর্ড বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে, যা দুর্নীতি রোধ করবে। জলমহাল ব্যবস্থাপনা কেবল মাছের জীববৈচিত্র সংরক্ষণের বিষয় নয়, এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। টেকসই সমাধানের জন্য স্বচ্ছ ইজারা ব্যবস্থা, ডিজিটাল মনিটরিং ও জলাশয় ব্যবস্থাপনা এবং জেলেদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ - এই তিনটি বিষয়ের সমন্বিত প্রয়োগ জলমহালের ইকোসিস্টেমের পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালান করে বলে প্রতীয়মান হয়।
পরিবেশ দূষণ (Pollution): বাংলাদেশের নদী-জলাশয়ে দূষণের মাত্রা আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, যার প্রধান উৎস শিল্প বর্জ্যের নিঃসরণ। যেমন, হাজারীবাগ ও সাভারের ট্যানারিসহ অন্যান্য কারখানা থেকে প্রতিদিন নি:সৃত অপরিশোধিত তরল বর্জ্যে মিশছে ক্রোমিয়াম, সিসা, সালফাইড-সহ আরে অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিক, যা নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা নামিয়ে আনেছে বিপদজনক মাত্রায়; ফলে মাছের বেঁচে থাকার ন্যূনতম সীমা অতিক্রম করছে প্রায়শই। নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরের মত শিল্পঞ্চলের টেক্সটাইল থেকে নির্গত অ্যাজো ডাই, ফর্মালডিহাইড ও ভারী ধাতু (আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম) মাছের ফুলকায় রক্তকণিকা ধ্বংস করে শ্বাসক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে। কৃষিখাতেও দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক; প্রতি বছর টনকে টন কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহার প্লাবনভূমি ও হাওরাঞ্চলে কখনোবা ইউট্রোফিকেশন (পানিতে দ্রবিভূত পুষ্টি ও সারের পরিমাণ জলাশয়ের ধারণ ক্ষমতারে চেয়ে বেড়ে যাওয়া) সৃষ্টি করে, যার ফলস্বরূপ কোন কোন বছর ব্যপকহারে মাছ মারা যায়। কারখানা ও কৃষি বর্জ্যের পাশাপাশি পৌর বর্জ্যও অভ্যন্তরীণ জলাভুমিগুলোর দূষণের জন্য দায়ী। শহর-নগরের অধিকাংশা বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় নদীতে গিয়ে পড়ে, যা জৈব দূষণ, ব্যাকটেরিয়া দূষণ ও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী।
সমাধানের উপায়: শিল্প ও অন্যান্য উৎস্য থেকে জলজ পরিবেশ দূষণের সংকট মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে তা নদী ও সংযুক্ত জলাভুমিগুলোর দূষণের মাত্রা ঠিক কমাতে পারছেনা। শিল্প দূষণ রোধে ট্যানারি ও টেক্সটাইল খাতে শূন্য-তরল নিঃসরণ (zero liquid discharge) ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করা উচিত। কৃষি দূষণ কমানোর জন্য জৈব বালাইনাশক ও জৈব সারের সম্প্রসারণ ফলদায়ক হতে পারে। এছাড়া ফসলের জমি থেকে নির্গত পানি ড্রেনে ধারণ করে রেখে শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে পুষ্টি ও রাসায়নিকের দূষণ কমিয়ে তারপর নদীতে ছাড়লে দূষণের মাত্রা কমবে। পৌর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ডিসেন্ট্রালাইজড ট্রিটমেন্ট কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর ’ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট করিডোর’ ও নদীতীরে ’অটোমেটেড প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কন্টেইনার’ স্থাপন প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্যের দূষণ কমানোতে ভূমিকা রাখতে পারে। নদী ও জলাভূমি দূষণ কমানোর নিমিত্ত একটি সমন্বিত রোডম্যাপ প্রণয়ন করা জরুরী যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা কর হবে যেমন, IoT-ভিত্তিক সেন্সর নেটওয়ার্ক স্থাপন করে রিয়েল-টাইমে দূষণের মাত্রা মনিটরিং, নৌযানে অয়েল-ওয়াটার সেপারেটর বাধ্যতামূলক করা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে নিয়মিতভাবে জাতীয় দূষণ ম্যাপ প্রকাশ করা। দূষণ নিয়ন্ত্রণ কেবল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, এটি প্রযুক্তি, আইন ও জনগণের অংশীদারিত্বের সমন্বিত প্রয়াস, যেখানে প্রতিটি নাগরিককে পরিবেশের প্রহরী হতে হবে, তবেই প্রতিটি নদী ফিরে পাবে তার প্রাণবন্ততা।
অত্যধিক আহরণ ও মৎস্য প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকি (Overexploitation & Loss of Fish Biodiversity): বাংলাদেশের নদী-হাওড়-বিলে মাছের অস্তিত্ব সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে অত্যধিক আহরণ, যা প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিও তৈরি করছে। দেশের স্বাদুপানির মাছের প্রজাতিগুলোর মধ্যে পঞ্চাশের অধিক প্রজাতি এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে, যার জন্য দায়ী মাছের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ, ধ্বংসাত্মক মাছধরা পদ্ধতি ও পেনা মাছ আহরণের মত কারণগুলো। কারেন্ট জালের মতো নিষিদ্ধ সরঞ্জামে প্রতি বছর হাজার হাজার টন ইলিশ পোনা (জাটকা) ধরা পড়ে, যা সরাসরি জাতীয় মাছটির সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা ও প্রজনন চক্রকে ধ্বংস করছে। একইভাবে, বেহুন্দি জাল বা ’ফিশ অ্যাগ্রিগেশন ডিভাইস’ (FAD)-এর মত ফাঁদে লক্ষ লক্ষ অপ্রাপ্তবয়স্ক রুই-কাতলা-দেশি পাঙ্গাস আটকা পড়ে, যাদের সিংহভাগই বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের অযোগ্য। এছাড়া, এসব অবাধ নিধনের শিকার হচ্ছে গুজি আইড়, বাঘাইড়, মহাশোলের মতো স্থানীয় ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিগুলো। সাম্প্রতিক গবেষণা ও সমীক্ষায় দেখা যায় যে, গত দু্ই দশকে মহাশোলের প্রাকৃতিক প্রজনন সিংহভাগই কমেছে, যার প্রধান কারণ তাদের ডিম ছাড়ার স্থান (নদীর পাথুরে তলদেশ) অপরিকল্পিত নদী খনন, পাথর উত্তোলন ও পলি জমে ধ্বংস হয়ে যাওয়া। একইভাবে পাবদা-গুলশা, শিং-মাগুরের মতো ছোট মাছগুলোও প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
সমাধানের উপায়: নদী, হাওড়, বাওড়, বিল প্রভৃতি প্রাকৃতিক জলাশয়ের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকা চিহ্নিত করে সেগুলোকে ’ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ জোন’ (ESZ) ঘোষণা করা যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদের জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে গুরুত্ব বিবেচনায় হাওর এলাকা জুড়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ এলাকায় স্থায়ীভাবে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা উচিত। সেইসাথে হাওর-বিলের হিজল, করচ, শাপলা-শালুকের জলা বনগুলো রক্ষা করা ও প্রয়োজনবোধে ধ্বংসপ্রাপ্ত বন পুন:সৃজন করা একান্ত জরুরী। মনে রাখতে হবে যে, এসব জলাবন মাছের প্রাকৃতি খাদ্য উৎপাদনে অবদান রাখে ও মাছের আশ্রয়স্থাল হিসেবে কাজ; এমনকি অনেক মাছ জলজ গাছের শিকড়, কান্ড ও পাতায় ডিম পাড়ে। তাই মাছের প্রজাতি রক্ষা করার জন্য বাসস্থান পুনরুদ্ধার কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এছাড়াও বিলুপ্তির পথে থাকা মছের ‘ক্রায়োপ্রিজার্ভেশন’ ও মাছের ‘জিন ব্যাংক ভিত্তিক প্রজনন’-এর পদক্ষেপও ভাল ফল দিতে পারে। অত্যধিক আহরণ রোধে জেলেদের জন্য ’অফ-সিজন লাইভলিহুড স্কিম’ চালু করা জরুরি। কিছু আইনি সংস্কার, যেমন - বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে মাছ ধরার জন্য ’বায়োলজিক্যাল মিনিমাম সাইজ’-এর পুন:সঙ্গায়ন করা ও বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ ঝুঁকিতে থাকা মছের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও অত্যধিক আহরণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। এছাড়া মাছের প্রজাতি বৈচিত্র্যের পাশাপাশি জিনগত বৈচিত্র্য রক্ষায় ’জাতীয় মৎস্য জিনোম প্রজেক্ট’ চালু করে স্থানীয় প্রজাতির মাছের জিনগত বৈশিষ্ট্যও সংরক্ষণ করা দরকার।
বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতির মত ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটিও যাতে বিলুপ্ত না হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা এই অভিধাটি ইতোমধ্যেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে, যখন দেখি মাছের অনেক গ্রামীণ রন্ধনপ্রথা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা কেবল প্রজাতি রক্ষার বিষয় নয়, এটি আমাদের জলজ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারেরও সংরক্ষণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের (Climate Change) ও আন্তঃসীমান্ত নদীর সংকট: বাংলাদেশের নদ-নদী ও জলজ বাস্তুতন্ত্র আজ জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তঃসীমান্ত নদীর হাইড্রোলজিক্যাল বিপর্যয়ের দ্বৈত চাপে বিপর্যস্ত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মতো নদীগুলি হিমালয় ও তিব্বত মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও, এগুলির পানিপ্রবাহ সম্পূর্ণভাবে উজানের দেশগুলির (যেমন- ভারত, নেপাল, চীন) উপর নির্ভরশীল। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদী ও সংযুক্ত বাস্তুতন্ত্রের (হাওড়-বিল-ঝিল) জন্য জীবনরক্ষাকারী পানির সিংহভাগ আসে হিমালয়ের স্থায়ী বরফখণ্ড (permafrost) ও পর্বতীয় বরফ গলার মাধ্যমে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমালয় অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ হারে বাড়ছে, যার ফলে পর্বতীয় বরফাচ্ছাদন হ্রাস এবং পারমাফ্রস্ট স্তর সংকোচন (permafrost Shrinkage) ঘটেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার সর্বোচ্চ প্রবাহ প্রতি দশকে ১৭% হারে হ্রাস পাচ্ছে, ফলে ভাটি-বাংলার হাওর-বাওরের মতো বাস্তুতন্ত্রকে শুষ্কতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সংকটের আরেকটি দিক হলো লবণাক্ততার উর্ধ্বমুখী অভিযান। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উজান থেকে পানির প্রবাহ হ্রাসের সম্মিলিত প্রভাবে লবণাক্ততার সীমা (Salinity Front) উপকূল থেকে দ্রুত উজানের দিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই দ্বিমুখী চাপ (শুষ্কতা ও লবণাক্ততা) বাংলাদেশের ’জলজ নার্সারি’ হিসাবে পরিচিত হাওড়-বিল-ঝিলের অস্তিত্বকে ধ্বংস করছে।
সমাধানের উপায়: এই মহাসংকট মোকাবিলায় একটি সমন্বিত কৌশল প্রয়োজন। প্রথমত, আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় ’ব্যাসিন ভিত্তিক পানি ব্যাবস্থাপনা’ চুক্তির মাধ্যমে ন্যূনতম প্রবাহ (Environmental Flow) নিশ্চিত করতে হবে। ভারত-নেপাল-চীন-বাংলাদেশের যৌথ ’হিমালয়ান গ্লেসিয়ার মনিটরিং নেটওয়ার্ক’ স্থাপন এবং জলবায়ু অভিযোজন তহবিল ব্যবহার করে হিমালয়ে বরফ সংরক্ষণ প্রকল্প (আইস স্টুপা নির্মাণ) বাস্তবায়ন করতে হবে, যা শুষ্ক মৌসুমে পানি অবমুক্ত করে আমাদের আমাদের নদী-খালে-বিলে পানি সরবরাহ করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, হিমালয়ের বরফ গলে গেলে বাংলাদেশের নদীই শুধু শুকাবে না, লবণাক্ততার বিষক্রিয়ায় মাছের বংশও ধ্বংস হবে।
মৎস্য অভয়াশ্রম ও প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার: বাংলাদেশের জলাশয়ে মাছের অভয়াশ্রম ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের পেছনে মূল কারণ হলো অবৈধ দখল ও ভূল ইজারা ব্যবস্থা। জলাশয়ের অধিকাংশই ইজারা দেওয়ার ফলে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ আর কোন জলা অবশিষ্ট থকে না। ধ্বংসাত্মক মৎস্য আহরণ যেমন - কারেন্ট জাল ও বোমা মেরে মাছ ধরার ফলে মাছের আনেক প্রজননক্ষেত্রের পরিবেশ-প্রতিবেশ মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া নদী-বিল সংযোগ বিচ্ছিন্নতা মাছকে তাদের ঐতিহাসিক প্রজননক্ষেত্রে পৌঁছাতে বাধা দেয়।সমাধানের উপায়: অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় জিআইএস ম্যাপিং ও স্থানীয় জেলেদের জ্ঞানকে সমন্বয় করে যথাযথ জায়গা বেছে নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে আইইউসিএন-এর গাইডলাইন অনুসারে জলাশয়ের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এলাকা অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধারে লক্ষ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বা ঝঁকিতে থাকা জলাশয়ে ব্যবস্থাপনা জোরদার কর জরুরী। যেমন, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা। উন্নত দেশগুলোর সাফল্যের উদাহরণ অনুসরণ করে ’অভয়াশ্রম বন্ড’-এর মত কার্যক্রমও শুরু করা যায় যেখানে বিনিয়োগকারীরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বার্ষিক লভ্যাংশ পাবেন। মাছ ধরার পরিমাণ কমানের জন্য স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়কে সহযোগিতা দিয়ে ’মৎস্য অভয়াশ্রম পর্যটন’ চালু চালু করে তাদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা যায়।
আইনি সংস্কার ও সমন্বয় (Legal Reform): বাংলাদেশের জলজ বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে আইনি কাঠামোর দুর্বলতা আজ একটি অদৃশ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় (যেমন - মৎস্য, পরিবেশ, স্থানীয় সরকার, নৌপরিবহন প্রভৃতি)-এর মধ্যে সমন্বয়হীনতা একটি প্রধান অন্তরায়। আইন অনুযায়ী মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্ব এক মন্ত্রণালয়ের, আবার মাছের বাসস্থান (জলমহাল)-এর দায়িত্বে আরেক মন্ত্রণালয়। সুন্দরবনের মত মাছের প্রাকৃতিক প্রজনক্ষেত্র ও নার্সারী গ্রাউন্ডের ব্যবস্থাপনা এককভাবে বন বিভাগের হাতে ন্যস্ত, অথছ এর ৪০%-ই মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধ জলাভূমি।
সমাধানের উপায়: প্রথমত, আইনগত সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য আইনে মৎস্য সম্পদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যেকোন প্রাকৃতিক জলাশয়ের ব্যবস্থাপনায় মৎস্য অধিদপ্তরকে সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা করা। নদী রক্ষা কমিশনকে ক্ষমতা দিয়ে জরিমানা আরোপ ও দূষণকারীর লাইসেন্স বাতিলের অধিকার দেয়া। প্রতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের জন্য ’জাতীয় জলজ সম্পদ কর্তৃপক্ষ’ বা অনুরুপ কোন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ গঠন করা এবং মৎস্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, নদী রক্ষা কমিশন ও স্থানীয় সরকারকে এর অন্তর্ভুক্ত করা। এছাড়া ডিজিটাল গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে ’জলজ ড্যাশবোর্ড’ প্ল্যাটফর্ম চালু করা যেখানে ই-লিজিং সিস্টেম ও জিপিএস পযুক্তির ব্যবহারে বাধ্যবাদকতা তৈরি করা যাতে জলাশয় ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আসে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন (যেমন রামসার কনভেনশন) মানার বিষয়টি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা।
কিশোরগঞ্জের ইতনা-মিঠামই-সহ হাওরাঞ্চলে অপরিকল্পিত রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণের ফলে মাছের জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব: কিশোরগঞ্জের ইতনা-মিঠামইন হাওরে অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণের ফলে সৃষ্ট জলজ বিপর্যয় শুধুমাত্র একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলব্যাপী হাওর এলাকার একটি ক্রমবর্ধমান সংকটের প্রতিচ্ছবি। এই হাওরটি কিশোরগঞ্জ ছাড়াও সংলগ্ন নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিস্তৃত জলাভূমি নেটওয়ার্কের অংশ, যেখানে অনুরূপ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর কারণে মাছের জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। ইতনা-মিঠামইনের মতোই নেত্রকোনার মদন, খালিয়াজুড়ি কিংবা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশায় নির্মিত অসংখ্য রাস্তা ও বাঁধ হাওরগুলোকে খণ্ডিত করে ফেলেছে। এসব নির্মাণে প্রায়শই কালভার্টের সংখ্যা অপর্যাপ্ত রাখা হয় (প্রতি কিলোমিটারে ২-৩টির বেশি নয়), আকার অত্যন্ত সীমিত এবং উচ্চতা পানির স্বাভাবিক প্রবাহের স্তরের নিচে নির্ধারণ করে নির্মাণ করায় বর্ষা মৌসুমে মাছের অত্যাবশ্যকীয় মাইগ্রেশন পথ ব্যাহত হচ্ছে; ফলে মাছ তার কাঙ্খিত প্রজননক্ষেত্রে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে অনেক মাছই প্রজনন করতে বা ডিম ছাড়তে ব্যথ্য হচ্ছে।
এই বিচ্ছিন্নতার প্রভাব শুধু মাছের মাইগ্রেশনেই সীমিত নয়, বরং সমগ্র জলজ বাস্তুতন্ত্রের শৃঙ্খলাকে ধ্বংস করছে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় কোথাও কোথাও দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, জলজ উদ্ভিদের আচ্ছাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে এবং পানি দূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। এসব অঞ্চলে মাছের ’মৌসুমী চলাচল’-এর মত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া (যেখানে মাছ বর্ষায় উজানের প্লাবনভূমিতে ডিম ছাড়ে ও শীতকালে গভীর জলাশয়ের বিলে ফিরে আসে) সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে শুধু মাছের সংখ্যাই কমছে না, জিনগত বৈচিত্র্যও হ্রাস পাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে প্রজাতির টিকে থাকার জন্য হুমকিস্বরূপ।
সমাধানের উপায়: সবার আগে দরকার বিদ্যমান অবকাঠামোগত ত্রুটিগুলো যতদুর সম্ভব ঠিক করা। ছোট কালভার্টগুলোকে সম্ভাব হলে প্রশস্ত করা, কালভার্টের সংখ্যা বাড়ানো, এবং সম্ভব হলে প্রশস্ত স্প্যানবিশিষ্ট আর্চ ব্রিজ নির্মাণ করা যাতে পানির প্রবাহ ও মাছের চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নিশ্চিত হয়। এছাড়া ফিশ পাস’ ও মাছের চলাচলের জন্য বাইপাস চ্যানেলের মাধ্যমে মাইগ্রেশন রুট পুনরুদ্ধার করতে হবে। এছাড়া, সমগ্র হাওর অঞ্চলের ’মৃত খাল’ গুলো চিহ্নিত করে সেগুলো পুনঃখনন করা জরুরী, যাতে করে পানির সংযোগ ও প্রাকৃতিক করিডোরগুলো সক্রিয় হয়। রাস্তা নির্মাণের কারণে বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে, রাস্তার উভয় পাশে নির্দিষ্ট বাফার জোন ঘোষণা করা এবং অপেক্ষাকৃত গভীর পুলগুলোকে ’বায়োলজিক্যাল স্যাংচুয়ারি’ হিসেবে সংরক্ষণ করা উচিত। পাশাপাশি আর কোন অপরিকল্পিত অবকাঠামো যাতে হাওরকে বিভক্ত করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা।
উপসংহার: বাংলাদেশের জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষার সংগ্রামে সমন্বিত পদক্ষেপই একমাত্র পথ। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে প্রকৌশলগত সমাধান (ফিশ পাস, জলাশয় পুনঃখনন), কঠোর আইনি প্রয়োগ (ধ্বংসাত্মক মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধকরণ, ইজারা ব্যবস্থার সংস্কার) এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ (অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা, কমিউনিটি নজরদারি) একত্রিত হলেই পরে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনার জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আঞ্চলিক সহযোগিতা ও অভিযোজন কৌশল অপরিহার্য। ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণের ফলে হাওরাঞ্চলের যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে যথাযথ ও কার্যকর অবকাঠামো সংষ্কার (যেমন, ফিশ পাস স্থাপন, আরো কালভার্ট নির্মাণ, ইত্যাদি) করা জরুরী। সর্বোপরি ’মাছে-ভাতে বাঙালি’ এই প্রবাদকে টিকিয়ে রাখতে হলে রাষ্ট্র, গবেষক, নাগরিক ও মৎস্যজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যেখানে প্রতিটি নদী তার প্রাণপ্রবাহ ফিরে পাবে, আর প্রতিটি জলাভূমি হবে জীববৈচিত্র্যের প্রাণবন্ত অভয়ারণ্য।
-(লেখক বৃন্দ সকলেই অধ্যাপক, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ)