প্রফেসর ড. মোঃ আলিমুল ইসলাম: প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। সমাজের সব মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তিনি আমৃত্যু কাজ করছেন। দাতাদের সাহায্যনির্ভরতা থেকে অর্থনীতিকে বের করতে বাণিজ্য উদারীকরণ করেছেন। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে চালু করেন ভ্যাট আইন। সব মিলিয়ে তিনিই প্রথম অর্থনীতির সংস্কার করেন।
মরহুম জনাব এম সাইফুর রহমান (৬ অক্টোবর ১৯৩২– ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯) ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদ যিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সর্বোচ্চ ১২ বার বার্ষিক অর্থ বাজেট পেশকারী অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এম সাইফুর রহমান ১৯৩২ সালে তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল বাছিত এবং মা তালেবুননেসা। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন এম সাইফুর রহমান। মৌলভীবাজার সরকারি হাইস্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫১ সালে সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে আইএ পাস করে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত লন্ডনে পড়াশুনা করেন এবং দি ইনস্টিটিউট অভ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অভ ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস (আইসিএইডাব্লিউ) থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টে ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি পেশাজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন। তিনি ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্যও ছিলেন।
এম সাইফুর রহমান ১৯৭৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সরকারের অর্থ, বাণিজ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি ভ্যাট, তৈরি পোশাক খাতে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা চালুসহ অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ও নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশকে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে নিয়ে গেছেন। সবার স্বার্থ সংরক্ষণ করেছেন। সেটি করতে গিয়ে অনেক সময় ব্যবসায়ীদের বিরাগভাজন হয়েছেন। তারপরও সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে চেষ্টা করে গেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কারে পেইনফুল সিদ্ধান্তগুলো সাইফুর রহমানই নিয়েছেন।
তিনি ১৯৯৪ সালে স্পেনের মাদ্রিদে বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সুবর্ণ জয়ন্তী সম্মেলনের গভর্নর নির্বাচিত হন। ১৯৮০ - ১৯৮২ মেয়াদে তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএফএডিতেও বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত তিনি এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন।
তার জাতীয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে যোগ দেন যা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে রূপান্তরিত হয়। তিনি ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সিলেট-১৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথমে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করলে বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের প্রায় সব নেতার সাথে তিনিও গ্রেফতার হন।
১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী (অর্থ মন্ত্রণালয়) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সিলেট-৪ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পুনরায় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার-৩ ও সিলেট-৪ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি সিলেট-১ ও মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন।
এম সাইফুর রহমান বাংলাদেশে মুক্ত বাজার সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রবর্তক হিসেবে সমধিক পরিচিত। তিনি স্বপ্ন দেখতেন- গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন, বেকার সমস্যা দূর করন, দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, মানব সম্পদকে দক্ষ করে গড়ে তোলার। তাঁর প্রবর্তিত অর্থনৈতিক সংস্কারের বিভিন্ন নীতিমালার কারণেই আজ কৃষি, পোল্ট্রি, হ্যাচারী, দুগ্ধ ও গরুর খামার এবং যুব প্রশিক্ষণ সহ অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজের জন্মস্থান সিলেট অঞ্চলের উন্নয়নেও অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। সিলেটের রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যালয়, কলেজ, হাসপাতাল এবং বিদ্যুৎ খাতে তার উদ্যোগ স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। তিনি সিলেটের মানুষদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও প্রগতিশীল নেতা হিসেবে সমাদৃত। স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে তিনি কৃষি, ব্যবসা এবং শিল্পখাতের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেন। তার নেতৃত্বে সিলেট প্রশাসনিক, অবকাঠামোগত, শিক্ষা ও সংস্কৃতিক দিক থেকে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন লাভ করেছে। তিনি নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সিলেটকে আধুনিক এবং দৃষ্টিনন্দন একটি নগরিতে পরিণত করেছেন। প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে এম সাইফুর রহমানের অবদান অপরিসীম। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বে সিলেট বিভাগ বাস্তবায়িত হয় এবং আলমপুরে বিভাগীয় পর্যায়ের সকল অফিস স্থাপন করা হয়।
শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নেও তাঁর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছায় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জে এম. সাইফুর রহমান কলেজ প্রতিষ্ঠা, সরকারী মহিলা কলেজের ছাত্রাবাস ও নতুন ভবন নির্মাণসহ শাহী ঈদগাহে স্বাস্থ্য সেবা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এবং আলমপুরে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও স্থাপিত হয়েছে। এছাড়া ওসমানী মেডিকেল কলেজ হোস্টেল নির্মাণ, বিকেএসপির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিভাগীয় স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন তাঁরই প্রচেষ্টার অংশ।
সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তার অবদানও উল্লেখযোগ্য। হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার এবং মানিক পীর (রহ.) মাজারের সংস্কার, শাহী ঈদগাহ ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান উন্নয়ন, মসজিদ, আলীয়া মাদ্রাসা, মন্দির ও গীর্জার সংস্কার ও উন্নয়ন, শিল্পকলা একাডেমী, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী এবং মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে মুক্তিযোদ্ধা স্কয়ার স্থাপন তাঁর ধারাবাহিক উন্নয়ন কার্যক্রমেরই অংশ।
স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তিনি মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল উন্নয়ন, নতুন ফায়ার স্টেশন স্থাপন ও সম্প্রসারণ, টিএন্ডটির নতুন এক্সচেঞ্জ, হার্ট ফাউন্ডেশনের উন্নয়ন এবং ডায়াবেটিকস হাসপাতালেও প্রচুর অনুদান প্রদান করেছেন। সার্বিকভাবে, এম. সাইফুর রহমানের উদ্যোগে সিলেট নগরী এবং পুরো বিভাগ আধুনিকায়ন ও দৃষ্টিনন্দন রূপ পেয়েছে। তার নেতৃত্বে সিলেট একটি প্রাণবন্ত, আকর্ষণীয় ও উন্নতমানের বিভাগ ও পর্যটন বিভাগ হিসেবে গড়ে উঠেছে।
এম সাইফুর রহমান প্রবর্তিত ভ্যালু এডেড টেক্সেস (ভ্যাট), কর ব্যবস্থার সংস্কার, শিল্প ব্যবস্থায় প্রাইভেটাইজেশন এবং উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা বাংলাদেশর অর্থনৈতিক অবস্থার আমুল পরিবর্তন সাধন করেছে। বলা যায় তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিনত করতে তিনি রেখেছেন অসামান্য অবদান। ভাষা আন্দোলনে তার অবদানের জন্য ২০০৫ সালে একুশে পদকও লাভ করেন। এছাড়াও সেনেগালের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা অর্ডার অব নেশন্যাল লাভ করেন।
সাইফুর রহমান ১৯৬০ সালে বেগম দূররে সামাদ রহমানকে বিয়ে করেন। তিনি তিন ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক। ২০০৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। তার পুত্র এম. নাসের রহমান মৌলভীবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়য়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ এক মহান রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, দূরদর্শী নেতা এবং দেশের উন্নয়নের একজন পথপ্রদর্শককে হারায়। তার জীবনের কাজ এবং স্বপ্ন বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করেছে। দেশের আর্থিক নীতি, শিল্প ও বাণিজ্য, শিক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এম. সাইফুর রহমানের জীবন আমাদের শেখায় যে, সংকল্প, নীতি ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার কর্ম, আদর্শ ও চিন্তাধারা চিরকাল বাঙালি জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। নিঃসন্দেহে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কর্ম জীবন শুধু বাংলাদেশকে নয়, পুরো বিশ্বকে দেখিয়েছে যে একটি দেশের অর্থনীতি ও সমাজকে শক্তিশালী করা অসম্ভব কিছু নয় যদি নেতৃত্ব দৃঢ়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং সমাজমুখী হয়।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আজ তাঁর 16তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করছে। মহান আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে তাঁর আত্মার শান্তি এবং বেহেস্তের উচ্চ মাকাম প্রার্থনাসহ তাঁর পরিবারের সকল সম্মানীয় সদস্যবৃন্দের দীর্ঘায়ু, সুস্বাস্থ্য, সুখ- শান্তি ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি।
লেখক:ভাইস-চ্যান্সেলর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।