রোগ থেকে দূরে রাখবে ফল

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

সমীরণ বিশ্বাস: প্রকৃতির অমূল্য দান হলো ফল। এতে রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ, আঁশ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। নিয়মিত ফল খাওয়ার অভ্যাস শরীরকে সুস্থ রাখে, হজমশক্তি বাড়ায়, রক্ত পরিশুদ্ধ করে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। অনেক ফল শরীরে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিকেল প্রতিরোধ করে বয়সের প্রভাব কমায় এবং মানসিক স্বাস্থ্যেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিদিন পর্যাপ্ত ফল খাওয়ার মাধ্যমে অকালমৃত্যু ও জটিল রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। তাই বলা যায়, ফল শুধু খাবার নয়, এটি প্রাকৃতিক ওষুধ, যা আমাদের রোগ থেকে দূরে রাখে এবং সুস্থ-সবল জীবনযাপনে সহায়তা করে। খনা বাংলার প্রাচীন জ্ঞানী নারী, যিনি কৃষি, ফল, ঔষধ ও জীবনযাপনের নানা বিষয় নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী ও উপদেশমূলক খনার বচন বলে গেছেন। ফল ও রোগ নিরাময় সম্পর্কেও খনার বেশ কিছু বচন আছে। দেশী ফল; রোগ দূরে করে টলমল।

দেশী ফল ভিটামিন সমৃদ্ধ :

বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া নানা ধরনের দেশী ফল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এ দেশের মৌসুমি ও সারাবছরের ফল শুধু স্বাদেই নয়, পুষ্টিতেও সমৃদ্ধ। দেশী ফলে বিদ্যমান ভিটামিন শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আম আমিষে ভরপুর একটি ফল হলেও এতে ভিটামিন এ ও সি রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। ভিটামিন এ চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ভিটামিন সি শরীরকে সতেজ রাখে ও রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। কাঁচা আম হজমে সাহায্য করে এবং গরমে শরীর ঠান্ডা রাখে। কলা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় দেশী ফল। এতে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি, পটাশিয়ামসহ নানা খনিজ উপাদান রয়েছে। কলা শক্তি জোগায়, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং হজমে সহায়ক। আমলকি ভিটামিন সি–এর ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, রক্ত পরিশোধন করে এবং ত্বককে সুন্দর রাখে। এছাড়া লেবু, কমলালেবু ও পেয়ারা শরীরে ভিটামিন সি–এর ঘাটতি পূরণে অসাধারণ। পেয়ারা শুধু ভিটামিন সি নয়, ভিটামিন এ ও আঁশে সমৃদ্ধ, যা হজম ও চোখের জন্য উপকারী। কাঁঠাল, লিচু, আতা, ডালিমসহ অন্যান্য দেশী ফলও নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজের উৎস। এগুলো শরীরকে শক্তি দেয়, রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। সার্বিকভাবে বলা যায়, দেশী ফল আমাদের জন্য প্রাকৃতিক ভিটামিন ও পুষ্টির ভাণ্ডার। নিয়মিত দেশী ফল খাওয়া শরীরকে রোগমুক্ত, সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখে। তাই দেশীয় ফলের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, চাষ বৃদ্ধি ও ভোগ বাড়ানো আমাদের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য সমানভাবে উপকারী।

দেশী ফল হজমে সাহায্য করে:

দেশী ফল শুধু সুস্বাদুই নয়, বরং হজম শক্তি বৃদ্ধিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশে সহজলভ্য আম, কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, পেয়ারা, জাম, লিচু ইত্যাদি ফল প্রাকৃতিক ভিটামিন, খনিজ লবণ ও আঁশে সমৃদ্ধ। এসব ফলের আঁশ (ফাইবার) আমাদের হজম প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, পেঁপেতে থাকা এনজাইম প্যাপেইন হজমের জন্য অত্যন্ত কার্যকর, যা প্রোটিনকে ভেঙে শরীরে সহজে শোষিত হতে সাহায্য করে। কলা দ্রুত শক্তি দেয় এবং পেটের অস্বস্তি কমাতে কার্যকর। পেয়ারা ও কাঁঠাল হজমে সহায়ক আঁশ সরবরাহ করে, যা অন্ত্র পরিষ্কার রাখে। এছাড়া জাম হজমের গণ্ডগোল ও অ্যাসিডিটি কমাতে সাহায্য করে। দেশী ফলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং পাকস্থলীর সুস্থতা বজায় রাখে। কৃত্রিম খাবারের তুলনায় দেশী ফল সহজে হজম হয়, ফলে পেটে ভারীভাব সৃষ্টি করে না। নিয়মিত দেশী ফল খেলে হজমতন্ত্র শক্তিশালী হয় এবং গ্যাস্ট্রিকসহ নানা হজমজনিত সমস্যার ঝুঁকি কমে। তাই সুস্থ জীবনযাপনের জন্য দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় দেশী ফল অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটি শুধু শরীরকে পুষ্টি জোগায় না, বরং হজম প্রক্রিয়াকে প্রাকৃতিকভাবে সুষ্ঠু ও স্বাস্থ্যকর রাখে।

ফলে প্রদাহ কমায়:

ফল শুধু শরীরকে সুস্থ রাখে না, বরং শরীরের ভেতরের প্রদাহ কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রদাহ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলেও দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও ক্যান্সারের মতো গুরুতর অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ধরনের ক্ষতিকর প্রদাহ প্রতিরোধে ফল প্রাকৃতিক ওষুধের মতো কাজ করে। অনেক ফলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও ফাইটোকেমিক্যাল থাকে, যা শরীরের ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিক্যালকে নিস্ক্রিয় করে। যেমন, আমলকি ও কমলালেবুতে ভিটামিন ‘সি’ প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। আঙুর ও ব্লুবেরিতে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন জয়েন্টের ব্যথা ও ফোলাভাব কমায়। আবার পেঁপে, আনারস ও পেয়ারা হজমে সাহায্য করার পাশাপাশি শরীরে প্রদাহবিরোধী এনজাইম তৈরি করে। এছাড়া কলা ও আপেলের ফাইবার অন্ত্রকে সুস্থ রাখে এবং প্রদাহের ঝুঁকি হ্রাস করে। নিয়মিত ফল খাওয়ার অভ্যাস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও টিস্যু পুনর্গঠনে সহায়তা করে। বাজারের প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে তাজা ফল বেছে নেওয়া প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তাই সুস্থ ও সক্রিয় জীবনযাপনের জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মৌসুমি দেশি ফল রাখা জরুরি। সারসংক্ষেপে বলা যায়, ফল হলো প্রাকৃতিক প্রদাহনাশক, যা দীর্ঘমেয়াদি রোগ থেকে আমাদের সুরক্ষা দেয়।

নারী খনা ফলকে শুধু আহার্য নয়, বরং প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবেও দেখেছেন। তাঁর বচনে বলা হয়েছে, দেশি মৌসুমি ফল নিয়মিত খেলে শরীর সুস্থ থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং ওষুধের প্রয়োজন অনেকটা কমে যায়। ফল প্রাকৃতিক ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও আঁশের ভাণ্ডার। নিয়মিত ও পরিমিত ফল খাওয়ার মাধ্যমে শরীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, হজমশক্তি ভালো থাকে এবং নানা জটিল রোগ থেকে সুরক্ষা মেলে। কৃত্রিম ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের তুলনায় দেশি ফল অধিক নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর। তাই সুস্থ, রোগমুক্ত ও কর্মক্ষম জীবন যাপনের জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ফলকে অপরিহার্যভাবে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। ফলই হতে পারে রোগ থেকে দূরে রাখার সহজ ও প্রাকৃতিক উপায়।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।