"কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাত:জীবনধারণ থেকে বাণিজ্যিক কৃষির আগামীর রূপরেখা

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

কৃষিবিদ ডা. শাহাদাত হোসেন পারভেজ: বাংলাদেশের কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এই তিন খাত মিলিয়ে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ১৫% আসে, যেখানে কৃষির অবদান ১১.২%, প্রাণিসম্পদের ১.৮০%, এবং মৎস্য খাতের ২.৫৩%। এ ছাড়া দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৪০% মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই তিন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত।অর্থাৎ, এই তিনটি খাত শুধুমাত্র খাদ্য নিরাপত্তাই নয়, গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, দারিদ্র্য হ্রাস ও জাতীয় প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি।

তবে বাস্তবতা হলো দেশের কৃষক, খামারী ও জেলেরা এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবনধারণ পর্যায়ের (subsistence level) উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের উৎপাদন লাভজনক নয়, বাজার অস্থির, এবং বিনিয়োগে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই। অতএব, বিএনপি আগামীতে জনগণের ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে প্রয়োজন হবে “কৃষিকে ব্যবসায়িক রূপান্তরের জাতীয় কৌশল” (National Strategy for Commercialization of Agriculture, Livestock & Fisheries) গ্রহণ করা।

নিচে আমি এই রূপান্তরের জন্য পয়েন্ট আকারে আমার প্রস্তাবনা তুলে ধরছি—

১. কৃষি খাতের জন্য নীতিগত প্রস্তাবনা

 ন্যায্য মূল্য ও বাজার সংস্কার: কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে উৎপাদক পর্যায়ে সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ ও আধুনিক কৃষিপণ্য বিপণন নেটওয়ার্ক তৈরি করা প্রয়োজন।  আধুনিক প্রযুক্তি ও যান্ত্রিকীকরণ: কৃষিতে ড্রোন, সেন্সর, আইওটি ও স্মার্ট ফার্মিং প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ‘Digital Agriculture Initiative’ গঠন করতে হবে।  ফসল বীমা ও প্রণোদনা: খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা বাজারমূল্য পতনের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য ফসল বীমা চালু করা জরুরি।  প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানি: কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্যাকেজিং শিল্পে কর রেয়াত ও রপ্তানি প্রণোদনা বাড়াতে হবে।

২. প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য নীতিগত প্রস্তাবনা

 দেশীয় জাত উন্নয়ন ও জেনেটিক ব্যাংক: স্থানীয় জাতের উন্নয়নে কৃত্রিম প্রজনন ও জেনেটিক ব্যাংক সম্প্রসারণ করতে হবে।  ডেইরি, পোলট্রি ও ক্ষুদ্র খামার উন্নয়ন: দেশে বর্তমানে প্রাণিসম্পদ খাত GDP-র প্রায় ২.১% অবদান রাখে এবং এ খাতে কর্মসংস্থান প্রায় ২০%। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্পসুদে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ বাড়াতে হবে।  রোগ প্রতিরোধ ও ভেটেরিনারি সেবা: প্রতি উপজেলায় মোবাইল ভেট সেবা চালু এবং দেশীয় টিকা উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।  প্রাণিসম্পদ বীমা: রোগ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পশু ক্ষতির জন্য প্রাণিসম্পদ বীমা চালু করলে খামারীরা আর্থিক নিরাপত্তা পাবেন।

৩. মৎস্য খাতের জন্য নীতিগত প্রস্তাবনা

 টেকসই উৎপাদন ও রপ্তানি: বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ মাছ উৎপাদক দেশ। মৎস্য খাত জাতীয় GDP-র ১.৮% এবং কৃষিজ GDP-র প্রায় ২৫% অবদান রাখে।  চিংড়ি শিল্প পুনরুজ্জীবন: রপ্তানি উপযোগী চিংড়ির মান উন্নয়ন, লবণাক্ত এলাকায় চাষের উপযোগী প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা জরুরি।  জেলেদের সামাজিক নিরাপত্তা: মৌসুমি নিষেধাজ্ঞা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রোগে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ও বীমা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।  মৎস্য বীমা ও পুনর্বাসন তহবিল: মৎস্য খাতের জন্য বিশেষ বীমা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে ঝুঁকি কমে ও বিনিয়োগ বাড়ে।

৪. সমন্বিত প্রস্তাবনা: তিন খাতের জন্য যৌথ পদক্ষেপ

লক্ষ্য: “বাংলাদেশকে জীবনধারণনির্ভর কৃষি অর্থনীতি থেকে লাভজনক, টেকসই ও রপ্তানিমুখী বাণিজ্যিক কৃষি রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।” এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের কৃষক, খামারী ও জেলেরা সত্যিকার অর্থে জাতীয় উন্নয়নের অংশীদার হবেন এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব হবে।

লেখক:সাধারন সম্পাদক, এগ্রিকালচারিস্টস’ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এ্যাব ঢাকা জেলা চ্যাপ্টার।। সাংগঠনিক সম্পাদক, ভেটেরিনারি ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ভ্যাব।