অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR): একটি নীরব মহামারী ও আমাদের করণীয়

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

ভূমিকা:
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বা AMR আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য একটি ভয়াবহ সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি এমন একটি অবস্থা যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও পরজীবী জাতীয় অণুজীব সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়ে সেই সব ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, যা দিয়ে আগে এদের দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণের চিকিৎসা করা যেত। এই প্রতিরোধ ক্ষমতার ফলে সাধারণ সংক্রমণও গুরুতর ও প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়, চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও জটিল হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা AMR-কে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য শীর্ষ দশ হুমকির মধ্যে একটি হিসাবে চিহ্নিত করেছে।

AMR কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে?: A

MR একটি প্রাকৃতিক বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া, কিন্তু মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। যখন আমরা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ ব্যবহার করি, সংবেদনশীল অণুজীবগুলি মারা যায়, কিন্তু কিছু প্রতিরোধী অণুজীব বেঁচে থাকে, সংখ্যাবৃদ্ধি করে এবং তাদের প্রতিরোধী জিন অন্যান্য অণুজীবের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় "প্রাকৃতিক নির্বাচন"-এর মাধ্যমে প্রতিরোধী স্ট্রেইনগুলি প্রাধান্য লাভ করে। সময়ের সাথে সাথে, এই ওষুধগুলি একেবারেই অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে।

AMR কেন একটি বৈশ্বিক সমস্যা?

AMR কোনো একটি দেশের সমস্যা নয়; এটি একটি বৈশ্বিক সংকট যে কোনো সীমানা মানে না। এর প্রধান চালিকা শক্তি হলো মানুষের স্বাস্থ্য, প্রাণিস্বাস্থ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের অতিরিক্ত ও অনুপযুক্ত ব্যবহার। প্রতিরোধী অণুজীবগুলি সহজেই দেশ থেকে দেশে, মানুষ থেকে মানুষে এবং পরিবেশের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বা AMR সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও এর প্রভাব সব জায়গায় একরকম নয়। একটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আফ্রিকার কিছু দরিদ্র অঞ্চলে AMR-এ মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রতি এক লাখ মানুষে প্রায় ২৪ জন এই সমস্যায় মারা যান। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে এই সংখ্যা মাত্র ৭ জন।

এই তারতম্য দেখে বোঝা যায়, AMR শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক সমস্যাও বটে। যেসব এলাকায় স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ কম, দরিদ্রতা বেশি এবং জনগণের সচেতনতার অভাব রয়েছে, সেসব অঞ্চলের মানুষই AMR-এর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে অসুখও বেশি হয়, আবার চিকিৎসাও কম পায়।

এক কথায় বলতে গেলে, AMR বিশ্বব্যাপী একটি হুমকি হলেও দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীই এর মূল মূল্য দিচ্ছে।

AMR-এর প্রধান চালকগুলো কি?

AMR-এর বিস্তারের পেছনে একাধিক কারণ দায়ী:

১. মানুষের মধ্যে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের অতিরিক্ত অপব্যবহার: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, ভাইরাল জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, এবং অসম্পূর্ণ কোর্স প্রধান কারণ।

২. প্রাণিচিকৎ্সা ও কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবহার: প্রাণির বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং রোগ প্রতিরোধ হিসেবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ব্যাপক ব্যবহার।

৩. দুর্বল সংক্রমণ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ: হাসপাতাল ও কমিউনিটিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা প্রতিরোধী অণুজীবের বিস্তারে সহায়তা করে।

৪. অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব: দূষিত পানি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ রোগজীবাণুর বিস্তারে সহায়তা করে।

৫. গবেষণা উন্নয়নের অভাব: নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের অনুপস্থিতি।

প্রাণিচিকৎ্সাদের ভূমিকা: AMR মোকাবেলায় অগ্রভাগের যোদ্ধা

প্রাণিচিকৎ্সারা AMR মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, কারণ প্রাণিস্বাস্থ্য খাতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ব্যবহার মানুষের মধ্যে AMR বিকাশের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। তাদের দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে:

১. দায়িত্বশীল অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ব্যবহার: শুধুমাত্র প্রয়োজনের ক্ষেত্রে এবং সঠিক রোগ নির্ণয়ের পরেই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ প্রেসক্রাইব করা। প্রাণির বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য রুটিনভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার এড়ানো।

২. প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা: টিকাদান, সঠিক পুষ্টি, এবং ভালো পালন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাণির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করা, যাতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়।

৩. নজরদারি রিপোর্টিং: প্রাণিতে AMR-এর ঘটনা নজরদারি করা এবং প্রতিরোধী অণুজীব শনাক্তকরণে সহায়তা করা।

৪. পশুপালক মালিকদের শিক্ষিত করা: দায়িত্বশীল অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা।

৫. এক স্বাস্থ্য পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ: মানুষের চিকিত্সক, কৃষিবিদ এবং পরিবেশবিদদের সাথে সমন্বয় করে AMR মোকাবেলা করা।

AMR প্রতিরোধে একীভূত পন্থা: অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল স্টুয়ার্ডশিপেরস্তম্ভ

AMR মোকাবেলায় শুধু চিকিৎসক বা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল স্টুয়ার্ডশিপের ৫টি স্তম্ভের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যায়:

১. প্রতিশ্রুতি: ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও জাতীয় পর্যায়ে AMR মোকাবেলার অঙ্গীকার করা। এর মধ্যে নীতি নির্ধারণ, অর্থবরাদ্দ এবং রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত।

২. প্রতিরোধ: সংক্রমণ যেনই না হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখা। এর মধ্যে রয়েছে টিকাদান, স্বাস্থ্যবিধি এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের মূল লক্ষ্য হল রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা।

৩. সনাক্তকরণ: দ্রুত ও সঠিকভাবে প্রতিরোধী অণুজীব শনাক্ত করে যথাযথ চিকিৎসা শুরু করা। উন্নত ডায়াগনস্টিক পদ্ধতির মাধ্যমে দ্রুত সনাক্তকরণ AMR-এর বিস্তার রোধে সহায়ক।

৪. ব্যবহার অনুকূলিতকরণ: শুধু প্রয়োজনের সময়ই সঠিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ, সঠিক মাত্রায় ও সঠিক সময়ের জন্য ব্যবহার নিশ্চিত করা। এটি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল স্টুয়ার্ডশিপের মূল লক্ষ ।

৫. নজরদারি: AMR-এর হার ও ওষুধের ব্যবহারের উপর নজর রাখা, যাতে কৌশল প্রণয়ন ও সাফল্য মূল্যায়ন করা যায়। নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ AMR-এর প্রবণতা বোঝার জন্য অত্যাবশ্যক।

সংক্রমণ প্রতিরোধ: ৫টি F-এর ধারণা

সংক্রমণ ছড়ানো রোধ করতে হলে সংক্রমণের উপায়গুলো বোঝা জরুরি। মল-মুখের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর পথটি সহজে বোঝার জন্য ৫F-এর ধারণা খুবই কার্যকর:

এই পাঁচটি উপায়ে সংক্রমণ ছড়ানো রোধ করতে পারলে AMR-সহ নানা ধরনের সংক্রমণের বিস্তার অনেকটাই কমানো সম্ভব। এছাড়াও খাদ্যবাহিত রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে এমন ৫টি F-এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য (দূষিত), আঙুল (অপরিষ্কার), মল, ফোমাইট এবং মাছি।

বিশ্ব AMR সচেতনতা সপ্তাহ (WAAW) আমাদের ভূমিকা

AMR-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতি বছর ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর বিশ্ব AMR সচেতনতা সপ্তাহ পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্যতম দাপ্তরিক প্রচারণা হিসাবে, WAAW বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ গ্রহণকে উৎসাহিত করে। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য হলো "এখনই কার্যকর করুন: আমাদের বর্তমানকে রক্ষা করুন, আমাদের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করুন." এটি AMR মোকাবেলায় জরুরি ও ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

AMR মোকাবেলায় 'এক স্বাস্থ্য' পদ্ধতি

AMR একটি জটিল সমস্যা যা শুধুমাত্র মানুষের স্বাস্থ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রাণিস্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এটির সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত 'এক স্বাস্থ্য' পদ্ধতি প্রয়োজন যা মানুষ, প্রাণি ও পরিবেশের মধ্যে interconnection স্বীকার করে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে মানব চিকিৎসা, পশুচিকিত্সা ও কৃষি ক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে কাজ করা যায়।

AMR-এর ভবিষ্যৎ প্রভাব

যদি AMR-কে নিরবচ্ছিন্নভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে এর ভবিষ্যৎ পরিণতি ভয়ানক হতে পারে:

উপসংহার: প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম

"প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম" এই প্রবাদটি AMR-এর ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রযোজ্য। সমস্যাটি ঘটার জন্য অপেক্ষা করা এবং তারপরে পরিণতি মোকাবেলা করার চেয়ে, সমস্যাটি হওয়ার আগেই তা এড়াতে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে ।

AMR-এর এই নীরব মহামারী রোধ করতে আমাদের সকলকে ভূমিকা রাখতে হবে:

কেবলমাত্র একটি সমন্বিত, সচেতন ও সক্রিয় প্রচেষ্টাই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে AMR-এর ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারে। আমাদের "বর্তমানকে রক্ষা" করে "ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত" করতে এখনই নীতি প্রনয়ন করা প্রয়োজন। প্রাণিচিকৎ্সক মানব চিকিৎসক, কৃষক, নীতি নির্ধারক এবং সাধারণ জনগণের সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টাই কেবল এই নীরব মহামারীকে প্রতিরোধ করতে পারে।