বাংলাদেশের কৃষির রুপান্তর: খোরপোষের কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষি

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

ড. এম আব্দুল মোমিন

খোরপোষের কৃষি কি?

খোরপোষের কৃষি মূলত কৃষক ও তার পরিবারের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য করা হতো, যেখানে জমির পরিমাণ যেমন কম ছিল তেমনি প্রযুক্তির ব্যবহারও ছিল সীমিত। খোরপোষের কৃষিতে কৃষক প্রধানত নিজের ও পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য ফসল উৎপাদন করতেন। এটি একটি প্রাচীন ও প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা যা এখনো বাংলাদেশের গ্রামীণ অনেক এলাকায় বিদ্যমান। এই ধরনের কৃষিতে সাধারণত: পরিবারভিত্তিক শ্রম ব্যবহৃত হয়, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত থাকে এবং উৎপাদিত ফসল বা পণ্য বাজারে বিক্রির জন্য নয়, বরং নিজ পরিবারের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়।

বাণিজ্যিক কৃষি কি ও কেন প্রয়োজন?

বাণিজ্যিক কৃষি হলো মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে অধিক জমি ব্যবহার করে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের শিক্ষিত তরুণেরা বাণিজ্যিক কৃষিতে ঝুঁকছেন কেনানা বাণিজ্যিক কৃষি এখন মূলত আগের তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয় ও লাভজনক। বাজারে ফসল বিক্রি করে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বাণিজ্যিক কৃষি কে সামাজিকভাবে এখন বেশ সম্মানের চোখেই দেখা হয়। মোদ্দাকথা হলো-শিল্পায়নের যুগে প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি এখন আর টেকসই নয়। কৃষিকে জনপ্রিয় ও লাভজনক করতে  খোরপোষের কৃষিকে বানিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে হবে।

বাণিজ্যিক কৃষিতে বৃহৎ আকারের যে জমি ব্যবহৃত হয় যেটাকে আমরা খামার বলে থাকি। সেই খামারে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট ফসলের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় (যেমন: ফুল, ফল, সবজি, মাছ, ব্রয়লার ইত্যাদি)। কেবল ফসল উৎপাদন নয়, কৃষির সঙ্গে যুক্ত থাকে ফসলের প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং, বিপণন, ও রপ্তানির বিষয়াদির সমন্বিত ব্যবস্থাপনা।

বাংলাদেশে এখনো অধিকাংশ কৃষক খোরপোষের কৃষিতে নিয়োজিত থাকলেও বিগত কয়েক দশকে বাণিজ্যিক কৃষির প্রসার ঘটেছে। শাকসবজি, পোলট্রি, মাছচাষ, ফুলচাষ, ফলচাষ এমনকি অর্গানিক ফসল চাষ এখন বাণিজ্যিক কৃষির আওতায় এসেছে। এটি দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলেছে। তবে এই রূপান্তরের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। খোরপোষের কৃষকদের অনেকেই মূলধন, প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অভাবে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর ঘটাতে পারছেন না। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাজারজাতকরণের সমস্যাসহ অনেক প্রতিবন্ধকতাতো রয়েছেই।

বেকারত্ব নিরসনে বাণিজ্যিক কৃষির গুরুত্ব?

দেশে প্রায় এক কোটির মতো মানুষ মনমতো কাজ পান না। তারা পড়াশোনা করেন না, কাজেও নেই। তাঁরা ছদ্মবেকার। কোনো রকম জীবনধারণের জন্য কাজ করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ, এবং প্রতিবছর নতুন করে ৪-৫ লাখ তরুণ এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। অথচ সেই তুলনায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে খুবই সীমিত পরিসরে। এই বাস্তবতাকে আমাদের মেনে নিতেই হবে সবার জন্য একযোগে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এখনই সম্ভব নয়। তবে সরকার চাইলেই এই বৃহৎ জনগৌষ্টির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে তাদের কে কর্মমুখি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে। যদিও এই সংকট মোকাবেলায় সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে বাস্তবে তা যথেষ্ট নয়। আমরা এখন জনসংখ্যার বোনাস পর্যায়ে রয়েছি, অর্থাৎ দেশের কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এই জনমিতিক সুযোগের স্থায়িত্ব থাকবে প্রায় ৩০-৪০ বছর। ফলে এখনই উপযুক্ত সময়, বিকল্প ও টেকসই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে বের করার। এ প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক কৃষি হতে পারে এক বিশাল কর্মক্ষেত্রের টেকসই প্ল্যাটফর্ম।

তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ?

বর্তমানে কৃষিতো শুধু হালের কোদাল-লাঙলের চাষ নয়, এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাণিজ্যিক খাত। একজন শিক্ষিত তরুণ যদি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও চাষাবাদ সম্পর্কে অল্প সময়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে তাহলে সঠিক পরিকল্পনা, আগ্রহ ও একাগ্রতা থাকলে অল্প পুঁজিতে প্রতি মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় করতে পারে। যা ছোট-খাটো চাকুরীর চেয়ে অনেক বেশি টেকসই ও সন্মানের। এ ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ সবসময় তরুণ উদ্যোক্তাদের পাশে আছে। প্রতিটি উপজেলাতেই রয়েছে কৃষি অফিস, যেখানে অঞ্চলভিত্তিক লাভজনক ফসল বা চাষাবাদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ পাওয়া যায়।

বহিঃবিশ্বের ন্যায় দেশের কৃষিতেও এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার। মৌসুমভিত্তিক চাষাবাদের ধারণা বদলে গিয়ে কিছু কিছু ফল ফসল এখন সারা বছরই উৎপাদিত হচ্ছে। বছরব্যাপি উৎপাদনের কারণে ন্যায্য দামও পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। দেশি ফলমূলের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন সফলভাবে চাষ হচ্ছে থাই পেয়ারা, ড্রাগন ফল, অ্যাভোকাডো, কিউই, রাম্বুটানসহ নানা বিদেশি ফল। এই পরিবর্তনের হাত ধরে গড়ে উঠছে এক নতুন কৃষি উদ্যোক্তা শ্রেণি যাদের বড় অংশই শিক্ষিত তরুণ। তাদের হাতে কৃষি এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, বিপণন কৌশল ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁচেছে।

বাণিজ্যিক কৃষির চ্যালেঞ্জ?

আশার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। এখনো কৃষি উদ্যোক্তার সংখ্যা দেশের চাহিদা অনুযায়ী খুব বেশি নয়। অনেক তরুণের মাঝেই রয়েছে সম্ভাবনা, কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা, পুঁজি, প্রশিক্ষণ ও নীতিগত সহায়তার অভাবে তারা কৃষিতে আসতে পারছে না। আরেকটি বিষয় হলো-বাংলাদেশের টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য দুই ধরনের কৃষির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। খোরপোষের কৃষকদের জন্য উন্নত বীজ, প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে তারা বাণিজ্যিক কৃষির দিকে অগ্রসর হতে পারবেন। পাশাপাশি, পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

এটি ঠিক যে, খোরপোষ কৃষি থেকে আধুনিক বাণিজ্যিক কৃষির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কৃষি বিজ্ঞানী, গবেষক, সম্প্রসারণবিদ ও কৃষিনীতি প্রণেতাগণ গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখে চলেছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি কাজটি করে থাকেন দেশের অসংখ্য ছোট বড় কৃষি উদ্যোক্তা, যারা কষ্টার্জিত পুঁজি সংস্থান করে ও ঝুঁকি নিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির সমাহার ঘটিয়ে বিনিয়োগ করে থাকেন। সরকারের উচিত এসব উদ্যাক্তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পুঁজি ও উৎপাদিত ফসল ও পণ্যের বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা। 

আমরা বর্তমানে কৃষির এক সম্ভাবনাময় ও ‘সুবর্ণ সময়ের’ দিকে এগিয়ে চলেছি-যেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং উদ্ভাবনী চাষাবাদ দেশের কৃষিকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিতে পারে। এখন প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ, যাতে কৃষির এই ইতিবাচক ধারা টেকসই হয় এবং আরও তরুণ এই খাতে যুক্ত হয়। সর্বোপরি, কৃষিকে শুধুমাত্র খাদ্য উৎপাদনের উৎস নয়, বরং একটি লাভজনক, সম্মানজনক ও পরিবেশবান্ধব পেশা হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে দেশের কৃষির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও কৃষি সাংবাদিক, ঊধ্বর্তন যোগাযোগ কর্মকর্তা,  বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)