
বাকৃবি প্রতিনিধি:বিশ্বে পরিবেশ দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। জনজীবন থেকে শুরু করে জলজ পরিবেশ সবই এর বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জলজ পরিবেশে বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তন ঘটছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং লবণাক্ততা বাড়ছে। ফলে মাছের বংশবিস্তার ও সহনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষক দল দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ মিঠাপানি ও সামুদ্রিক মাছের জন্য জলবায়ু-সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন গবেষণা শুরু করেছে। এই গবেষণা প্রকল্পটি ইউজিসি ও বিশ্বব্যাংক সমর্থিত হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং (হিট) প্রকল্পের অর্থায়নে পরিচালিত হবে। এই গবেষণার মূল লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, লাভজনক ও টেকসই মৎস্যচাষ প্রতিষ্ঠা করা।
সম্প্রতি মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের সম্মেলন কক্ষে প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
প্রকল্পের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় সহকারী অধ্যাপক মো. ড. আল ইমরান বলেন, এটি ৩ বছর মেয়াদী একটি গবেষণা প্রকল্প। এতে চারটি প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—
১. রুই মাছের খাদ্যে উপকারী অণুজীব, মাইক্রোঅ্যালজি, ভিটামিন–ই ও সেলেনিয়াম সংযোজন করে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার ক্ষতিকর প্রভাব কমানো।
২. রুই মাছের তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা সহনশীলতা মূল্যায়ন করে উপকূলীয় অঞ্চলে বাণিজ্যিক চাষের সম্ভাবনা যাচাই।
৩. ভেটকি (সি-বাস) মাছ চাষের উপযোগী প্রযুক্তি তৈরি করে দেশব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে চাষ সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি।
এবং, ৪. রুই ও ভেটকি মাছের জলবায়ু সহনশীল চাষাবাদ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
প্রকল্পের প্রধান পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহজাহান বলেন, “বর্তমানে স্বাদুপানির মাছচাষ বিশেষ করে তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লাভজনকতা হারাচ্ছে। যেখানে প্রতি কেজি মাছ উৎপাদনে ১০০ টাকা খরচ হয়, কৃষকরা নামমাত্র মুনাফা পান। তাই বিকল্প হিসেবে আমরা সামুদ্রিক ভেটকি মাছকে রিসার্কুলেটরি অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেমে (আরএএস) অভিযোজিত করার কাজ করছি।”
তিনি আরও বলেন, “যদি ভেটকি মাছ সফলভাবে আরএএস প্রযুক্তিতে উৎপাদন সম্ভব হয়, তবে প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ ২০০ টাকা হলেও বাজারদর ৬০০ টাকা। ফলে কৃষকরা কেজিপ্রতি প্রায় ৪০০ টাকা লাভ পাবে। যা বর্তমান স্বাদুপানির মাছচাষের তুলনায় বহুগুণ বেশি লাভজনক। ইতোমধ্যে ছোট স্কেলে মডেলটি সফল হয়েছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ‘খাঁচায় চাষ’ ও আরএএস সিস্টেমে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা চলছে।”
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “ইউজিসি ও বিশ্বব্যাংক সমর্থিত হিট প্রকল্পে নয়টি প্রকল্পের মধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ স্কোরারদের একজন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে । এটি বাকৃবির জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। সহকর্মীদের কঠোর পরিশ্রম, দক্ষতা ও নিষ্ঠার ফলস্বরূপ এ অর্জন সম্ভব হয়েছে।”
উপাচার্য আরও উল্লেখ করেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাছচাষ পদ্ধতিতে ব্যাপক উন্নয়ন আনা জরুরি। কোন প্রযুক্তি ও কোন ধরনের ফিশ-কালচার মডেল ভবিষ্যতের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে—তা এই প্রকল্পে সুস্পষ্টভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। আমি চাই, প্রকল্পে স্নাতক পর্যায়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা হোক, যাতে তারা হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে এবং গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠে।”
এই প্রকল্পের প্রধান হিসেবে আছেন অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান, তাঁর পাশাপাশি সহকারী হিসেবে আছেন ড. মো. আল ইমরান, এবং সদস্য হিসেবে আছেন অধ্যাপক ড. সালেহা খান।
কর্মশালায় ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. কাইজার আহমেদের সুমনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বাকৃবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম সারদার, উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা কমিটির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক ও ইউজিসি-এটিএফ সেক্রেটারিয়েটের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মোশাররফ উদ্দিন ভূঞা।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যাপক ড সালেহা খান। কর্মশালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, পিএইচডি এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।