আলু চাষে সারের গুরুত্ব এবং সংকটে করনীয়

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

সমীরণ বিশ্বাস:আলু চাষ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শীতকালীন ফসল, যার উৎপাদনে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও জিপসামের মতো সুষম সার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে সার সরবরাহ কমে যাওয়া, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, ডিলার পর্যায়ে মজুদ সংকট এবং অনিয়ন্ত্রিত বেশি দামে বিক্রির কারণে আলু চাষীরা তীব্র সারসংকটে পড়ছেন। সময়মতো সার প্রয়োগ না করতে পারায় জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, কন্দ গঠনে সমস্যা হচ্ছে এবং ফলন ঝুঁকিতে পড়ছে। বাজারে সারদামের অস্থিরতাও কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন সুষম সার ব্যবস্থাপনা, সারের ন্যায্য মূল্যে দ্রুত সরবরাহ, কৃষি অফিসের নজরদারি বৃদ্ধি এবং জমির মাটির পরীক্ষার ভিত্তিতে সার প্রয়োগ। পাশাপাশি জৈবসার ও বিকল্প পুষ্টি ব্যবস্থার ব্যবহার বাড়ালে সার নির্ভরতা কমবে এবং আলু উৎপাদন আরও টেকসই হবে।

আলু চাষীদের সার সংকটের মূল কারণ:

সরবরাহ ব্যবস্থার সমস্যা: সরকারি গুদাম থেকে পরিবেশক ও খুচরা বাজারে সার পৌঁছাতে দেরি হওয়া। পরিবেশকদের ডেলিভারি শিডিউল ঠিকমতো না মানা। চাহিদা, যোগানের অসামঞ্জস্য: আলু মৌসুমে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি-এর চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়। অনেক সময় আমদানি কম বা দেরিতে হওয়ার কারণে বাজারে ঘাটতি তৈরি হয়। অসাধু মজুতদারি ও অতিরিক্ত দামে বিক্রি: কিছু ব্যবসায়ীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর প্রবণতা। চাষীরা তাই নির্ধারিত দামে সার পান না। পরিবহন সমস্যা: জ্বালানি দাম বৃদ্ধি বা পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সার পরিবহন ব্যাহত হলে সংকট তৈরি হয়। কৃষকের অজ্ঞতা বা ভুল পরিকল্পনা: অনেক চাষী মৌসুমের শুরুতে প্রয়োজনীয় সার আগেভাগে সংগ্রহ করেন না। কতটা সার লাগবে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে শেষ মুহূর্তে বেশি চাপ পড়ে।

 সমাধানের কার্যকর সুপারিশ:

সরকারি পর্যায়ে করণীয়: গুদাম, পরিবেশক,  খুচরা দোকান পর্যন্ত সার সরবরাহ চেইন আরও শক্তিশালী করা। ভ্রাম্যমাণ টিমের মাধ্যমে মজুতদারি ও অতিরিক্ত দামে বিক্রি বন্ধ করা। আলু মৌসুমের আগে পর্যাপ্ত সার আমদানি ও গুদামে মজুত নিশ্চিত করা। চাষীদের করণীয়: মৌসুম শুরুর আগে প্রয়োজনীয় সার সংগ্রহ করে রাখা। স্থানীয় কৃষি অফিস/উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা (SAAO), এর পরামর্শ অনুযায়ী মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজন অনুযায়ী সার ব্যবহার করা। বিকল্প সার ব্যবহার: জৈব সার (গোবর, কম্পোস্ট)। বায়োফার্টিলাইজার: এগুলো রাসায়নিক সারের চাহিদা কমায়। সমবায় ভিত্তিক পদক্ষেপ: এলাকার চাষীরা মিলে কো-অপারেটিভ ফার্মিং বা দলগতভাবে সার কিনলে দাম স্থিতিশীল থাকে। মজুত ও সংরক্ষণে সুবিধা হয়। ডিজিটাল মনিটরিং: প্রতিটি এলাকার সার সরবরাহ, স্টক, দাম, এসব ডিজিটালভাবে প্রকাশ করলে সংকট ও গুজব কমে।

ইউরিয়া ছাড়া অন্য সারের সংকট:

বাংলাদেশে রবি মৌসুমে আলু অন্যতম প্রধান ফসল, যার উৎপাদনে সুষম সারের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আলুর পুষ্টি প্রয়োজন ইউরিয়ার (নাইট্রোজেন) ওপর নির্ভর করলেও, কৃষি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শুধু নাইট্রোজেন নয়, ফসফরাস (TSP), পটাশ (MOP), সালফার (জিপসাম) ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট অত্যাবশ্যক। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য প্রয়োজনীয় সারের তীব্র ঘাটতি বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় বেশি দামে সার বিক্রি হওয়ায় কৃষকের উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাচ্ছে।

বৈজ্ঞানিকভাবে আলুর শিকড়ের বৃদ্ধি, কন্দ গঠন, রোগ প্রতিরোধ এবং ফটোসিন্থেসিস প্রক্রিয়া TSP, MOP ও জিপসামের সঠিক সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল। ফসফরাসের ঘাটতি হলে গাছের শিকড় দুর্বল হয়, ফলে গাছ ঠিকমতো খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। পটাশের ঘাটতি কন্দের আকার ছোট করে দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যা ভাইরাস ও ছত্রাকজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সালফারের অভাব হলে পাতায় ক্লোরোফিল তৈরি কমে যায়, ফলে আলুর গাছ দুর্বল হয় এবং উৎপাদন ২০–৩০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। তাই শুধুমাত্র ইউরিয়া থাকা মানেই উৎপাদন সুরক্ষিত নয়; সুষম পুষ্টি ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য।

বর্তমান সংকটের পেছনে বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিকই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি–নির্ভর TSP, MOP ও DAP–এর মূল্য বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ, লজিস্টিক জটিলতা এবং ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থার দুর্বলতা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে খুচরা বাজারে মজুতদারি ও অস্বচ্ছ বাণিজ্য নেটওয়ার্ক দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরবরাহ কমে গেলে কৃষকরা সময়মতো সার প্রয়োগ করতে পারে না, যা আলুর জীবনচক্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, কন্দ গঠন ও সাইজ বৃদ্ধিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

দীর্ঘমেয়াদে এই সংকট কৃষকের লাভজনকতা কমিয়ে দেয় এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আলু সরবরাহ কমলে বাজারদর অস্থিতিশীল হয়, প্রক্রিয়াজাত শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভোক্তা পর্যায়েও মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয়। কৃষি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য সারের সাপ্লাই–চেইনের স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা, আমদানির বিকল্প হিসেবে স্থানীয় সার উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, মাটির পরীক্ষা–ভিত্তিক সুষম সার ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক পুষ্টি প্রযুক্তি (ওয়াটার সলিউবল ফার্টিলাইজার, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট মিশ্রণ) ব্যবহারের প্রচার জরুরি। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সারের সংকট শুধু সাময়িক বাজার সমস্যা নয়; এটি একটি বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক ও নীতিগত সমন্বিত চ্যালেঞ্জ, যা সমাধান না হলে আলু চাষ, কৃষকের আয় এবং খাদ্য নিরাপত্তা তিনটিই ঝুঁকির মুখে পড়বে।

করনীয় ও সমাধান :

কৃত্রিম সংকট রোধে কঠোর নজরদারি: ডিলার, পরিবেশক ও গুদাম পর্যায়ে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। নির্ধারিত দামে সার বিক্রি নিশ্চিত করা: কৃষকদের কাছে ডিজিটাল কার্ড বা নিবন্ধন ভিত্তিক সার বিতরণ কার্যকর করা যেতে পারে। সরকারি মজুত বাড়ানো: রবি মৌসুমে আগাম আমদানি বা স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিকল্প সারের ব্যবহার উৎসাহ: জৈব সার ও এনপি কে ভিত্তিক বিকল্প সারের ব্যবহার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মাঠ পর্যায়ে দ্রুত সরবরাহ: কৃষি বিভাগ, ইউএনও এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগে তা নিশ্চিত করা দরকার।

 

আলু চাষে সারসংকট মোকাবিলায় কৃষকদের পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সারের চাহিদা অনুযায়ী আগাম মজুত পরিকল্পনা, বিকল্প সার যেমন জৈব সার, কম্পোস্ট ও ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার, এবং ভারসাম্যপূর্ণ সার প্রয়োগ মাটির উর্বরতা ধরে রাখতে সহায়তা করবে। স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী সারের সঠিক মাত্রা নির্ধারণ, গুচ্ছ বা গ্রুপভিত্তিক সার সংগ্রহ, এবং বাজারে অতিরিক্ত দামের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোই হতে পারে কার্যকর করণীয়। বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় সার সংকটের প্রভাব কমিয়ে আলু উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।

 

আলু চাষীদের সার সংকট মূলত সরবরাহ চেইনের দুর্বলতা, চাহিদা বৃদ্ধি, মজুতদারি, ও মাঠ পর্যায়ে পরিকল্পনার অভাব থেকে সৃষ্টি হয়। সমন্বিত সরকারি তদারকি, চাষীদের আগাম প্রস্তুতি, এবং জৈব সার ব্যবহারের সম্প্রসারণ, এই তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সংকট অনেকাংশে দূর হবে।

 

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।