
মেহেদী ইসলাম: গত এক দশকে বাংলাদেশের মিঠাপানির অ্যাকুয়াকালচার খাত অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে। এর মধ্যে পাঙ্গাস (Pangasianodon hypophthalmus) মাছ আজ স্বল্পমূল্যের প্রোটিন সরবরাহ, গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম স্তম্ভ। বিশেষ করে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল ও ভালুকা উপজেলা—যা দেশের পাঙ্গাস উৎপাদনের প্রধান হাব হিসেবে পরিচিত—হাজার হাজার খামারি, হ্যাচারি, ফিড মিল, পরিবহন ও সংশ্লিষ্ট সেবাখাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে ব্যাসিলারি নেক্রোসিস অব পাঙ্গাস (Bacillary Necrosis of Pangasius–BNP) নামক একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের উপস্থিতি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, যা মাছের স্বাস্থ্য, উৎপাদন ও সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই রোগটি কেবল মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত।
ব্যাসিলারি নেক্রোসিস কী?
ব্যাসিলারি নেক্রোসিস একটি সিস্টেমিক ব্যাকটেরিয়াল রোগ, যা মূলত পাঙ্গাস মাছের লিভার, কিডনি ও প্লীহা-তে মারাত্মক নেক্রোসিস (কোষ ও টিস্যু ধ্বংস) সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী, এই রোগের প্রধান জীবাণু হলো—
Edwardsiella ictaluri (গ্রাম-নেগেটিভ, ফ্যাকালটেটিভ ইনট্রাসেলুলার ব্যাকটেরিয়া)। এই ব্যাকটেরিয়াটি পাঙ্গাস ও ক্যাটফিশে ব্যাসিলারি নেক্রোসিসের প্রধান কারণ হিসেবে বহু গবেষণায় চিহ্নিত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে Aeromonas hydrophila বা Pseudomonas spp. সহ-সংক্রমণ হিসেবে পাওয়া গেলেও, ক্লাসিক ব্যাসিলারি নেক্রোসিসে E. ictaluri-ই মূল রোগজীবাণু।
রোগের উৎপত্তি ও বৈশ্বিক ইতিহাস
ব্যাসিলারি নেক্রোসিস প্রথম শনাক্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাটফিশ শিল্পে এবং পরবর্তীতে ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঙ্গাস শিল্পে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রমাণ করে যে, উচ্চ ঘনত্বে চাষ, পানির মানের অবনতি, হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনাগত চাপ এই ব্যাকটেরিয়াকে রোগসৃষ্টিতে সহায়তা করে—যা বাংলাদেশের পাঙ্গাস চাষ ব্যবস্থার সঙ্গে অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ।
ত্রিশাল ও ভালুকার সাম্প্রতিক বাস্তবতা
সম্প্রতি ত্রিশাল ও ভালুকার একাধিক পাঙ্গাস খামারে আক্রান্ত মাছের ডিসেকশন ও পোস্ট-মর্টেম পরীক্ষায় দেখা গেছে—
- কিডনিতে অসংখ্য সাদা নডিউল ও নেক্রোটিক দাগ
- লিভার ফোলা, বিবর্ণ ও ক্ষতযুক্ত
- গলব্লাডার অস্বাভাবিকভাবে বড় ও গাঢ় রঙের
এই অঙ্গগত পরিবর্তনগুলো আন্তর্জাতিক গবেষণায় বর্ণিত ব্যাসিলারি নেক্রোসিসের লক্ষণের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা রোগটির উপস্থিতিকে আরও শক্তভাবে নির্দেশ করে।
কেন এটি একটি ‘নীরব ঘাতক’?
এই রোগের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—
আক্রান্ত মাছের বাহ্যিক লক্ষণ অনেক সময় খুবই সামান্য থাকে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো দ্রুত ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে খামারিরা রোগটি শনাক্ত করতে পারেন তখনই, যখন হঠাৎ করে ব্যাপক মাছ মারা যেতে শুরু করে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: এখনই ব্যবস্থা না নিলে কী হতে পারে?
উৎপাদন ক্ষতি
আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাসিলারি নেক্রোসিসে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ৩০–৭০% পর্যন্ত মৃত্যু হার হতে পারে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের জন্য এর অর্থ কোটি টাকার সরাসরি উৎপাদন ক্ষতি।
বাজার ও সরবরাহে ধাক্কা
ত্রিশাল–ভালুকা থেকে পাঙ্গাস সরবরাহ কমে গেলে—
- বাজারে দাম অস্থির হবে
- ফিড, হ্যাচারি ও পরিবহন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে
- গ্রামীণ জীবিকা ও কর্মসংস্থান
- গ্রেটার ময়মনসিংহ অঞ্চলে লক্ষাধিক পরিবার পাঙ্গাস চাষের ওপর নির্ভরশীল। বড় আকারের রোগপ্রাদুর্ভাব হলে আয় হ্রাস, বেকারত্ব ও সামাজিক চাপ বৃদ্ধি পাবে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা
- পানির মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ (NH₃, NO₂, DO)
- স্লাজ ও জৈব বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ
- ভিটামিন C, E, জিঙ্ক ও প্রোবায়োটিক ব্যবহার
- অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক পরিহার
- ল্যাবভিত্তিক রোগ নিশ্চিতকরণ (কালচার, PCR)
উপসংহার
ব্যাসিলারি নেক্রোসিস কোনো সাধারণ বা সাময়িক সমস্যা নয়। এটি একটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক রোগ। বিশেষ করে ত্রিশাল ও ভালুকার মতো পাঙ্গাস উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে এখনই সচেতনতা, গবেষণা-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পাঙ্গাস শিল্প বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও দায়িত্বশীল চাষ ব্যবস্থাপনাই এই সংকট মোকাবিলার একমাত্র পথ।
-লেখক: মার্কেটিং ম্যানেজার, ACI Aquaculture