সমীরণ বিশ্বাস: বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আয়তনে ছোট্ট কিন্তু জনবহুল একট দেশ এ কথা যেমন সত্য, তেমনি ফসল উৎপাদনে এক সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবেও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আজকের এই সময় দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্ব ভীষণ প্রস্তুত হয়ে পড়ছে। আর এগুলির কারণ হলো ; সমাজে, দেশে ঘাপটি মেরে থাকা বৈষম্য, দুর্নীতি, যুদ্ধ বিগ্রহ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিভিন্ন মহামারী । জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব গত কয়েকটি বছর ধরেই চলছে বাংলাদেশ তথা বিশ্বজুড়ে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) র মতে, বিশ্বের ৪৫ টি দেশে ঘাটতিজনিত মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা এখন সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশভুক্ত দেশ আছে নয়টি, যার মধ্যে বাংলাদেশ সহ তিনটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ার। এফএও র হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরই বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য উৎপাদন কমবে ১.৪ শতাংশ। বাংলাদেশ এর বাইরে থাকবে না। আর এই দিকগুলো বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের উৎপাদন পরিকল্পনা চলমান রাখতে কার্যকারী পদক্ষেপ ও কর্মসূচি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে গ্রহণ করতে হবে ।
বাংলাদেশে মোট ১ কোটি ৬১ লক্ষের মতো ফসলি জমির মধ্যে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে ৮৬ লাখ ২৯ হাজার হেক্টরের মতো। তার মধ্যে আবার যোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ৪ লক্ষ ৩২ হাজার হেক্টরের মতো। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই আবাদযোগ্য জমি যদি আমাদের আওতায় আনা যায়, তাহা হলে আমাদের খাদ্য সংকট মোকাবিলায় যেমন ভূমিকা পালন করবে, তেমনি গ্রামীণ আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ফল-প্রসু হবে।
বাংলাদেশের প্রায় ২৫৩.৬০ লাখ বসতবাড়ি রয়েছে, যার পরিমাণ ৫.৪০ লাখ হেক্টর। দেশের বসতবাড়ির গড় আয়তন ০.০২ হেক্টর। কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১৬৫.৬২ লাখ এবং আবাকযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ২.২৩ লাখ হেক্টর। এই জমিগুলো আবাদের আওতায় আনার লক্ষ্যে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পতিত জমি চাষের আওতায় আনা এবং বসতবাড়ি রাঙিনা বিভিন্ন সবজি চাষের আওতায় আনা অতীব জরুরী।
পাহাড়েও অনেক পতিত জমি রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষায় দেখা যায় যে, রাঙ্গামাটি ,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য জেলায় অন্তত ৫ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদী পড়ে আছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের অব্যবহৃত জমি, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পার্ক, লাইব্রেরী, ধর্মীয় উপাসনালয়ের অবব্যবহৃত জমি রয়েছে যেগুলো খুব সহজেই আবাদের আওতায় আনা যায়। এছাড়া বসতবাড়ির ছাদে বাগান করে বেশ জনপ্রিয় একটি কাজ করা যেতে পারে । পাশাপাশি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়িয়ে এবং উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে, কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সমন্বয়ে ঘটিয়ে কৃষিকে একটি টেকসই ও যুগউপযোগী করে গড়ে তোলার এখনই সময়।
আসছে,আসন্ন ২০২৩-২৪ বৎসরে রবি মৌসুমে বোরো ধান ,গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম, শীতকালীন মুগ, শীতকালীন বিবিধ সবজি, পিয়াজ ইত্যাদি ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ, জ্বালানি তৈল, বিদ্যুৎ এবং কৃষি ঋণ) সহায়তা ও প্রাপ্তি নিশ্চিত করা অতীব জরুরী। ব্রির উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত বর্তমানে দেশের বোরো ধানের (শীতকালীন ধান) ৮২%, আউশের (গ্রীষ্ম কালীন) ৩৬% এবং রোপা আমনের (বর্ষাকালীন ধান) ৪৭% এলাকা চাষ হচ্ছে। বর্তমানে দেশের মোট ৭৫% জমিতে ব্রি ধানের চাষ হয় এবং এর থেকে দেশের মোট ধান উৎপাদনের শতকরা ৮৫ ভাগ আসে। আসন্ন বোরো মৌসুমের ব্রির উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত প্রতি বছর ধান উৎপাদন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। তাই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট কৃষি মন্ত্রণালয়ের, আসন্ন বোরো মৌসুমের সফল ধান উৎপাদনের জন্য কৃষি ও কৃষকদের কল্যাণে সর্বোচ্চ বিবেচনা এবং মনোযোগী হবার এখনই সময়।
উত্তম কৃষি চর্চা (GAP) হলো; সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম, যার অনুসরণে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য, পরিবেশ সুরক্ষা ,অর্থনীতি এবং সমাজ সুসংহত হয়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চার নীতিমালার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্য পণ্য রপ্তানি বাংলাদেশের কৃষিকে অধিকতার সুসংহত করবে। খামার পর্যায় হতে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করতে, খামারে উৎপাদন এবং উৎপাদনউত্তর প্রক্রিয়ায় উত্তম কৃষি চর্চা (GAP) বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষি বাঁচলে দেশের মানুষ দুমুঠো খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারবে, এই কথাটি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। গত অক্টোবরে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, ২০২৩-২৪ সালে একটি মারাত্মক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার তথা কৃষি উপদেষ্টাকে সামগ্রিকভাবে কৃষির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে, কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিতে হবে, এর কোন বিকল্প নাই।
লেখক:কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।