বৈষম্যের সংস্কার চাই, বিজ্ঞানীদের মর্যাদা চাই!!

ড. মুহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন: গবেষক হিসেবে বিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ পদ "মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা" পদটি ১ নং গ্রেডে দেখতে চাই। পিএইচডিধারী বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদটি ৩নং গ্রেডেই শেষ কেন?? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদটি ৩নং গ্রেড হতে ১নং গ্রেডে উন্নীত হয় না?? এটি আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে! এই প্রশ্ন মেধাবীদের বলয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্মানিত উপদেষ্টা মহোদয়দের কাছে। বিজ্ঞানীরা সরব কন্ঠে আওয়াজ তুলছেন “বৈষম্যের সমাধান চাই” এবং “দেশের জন্য উর্বর চেতনায়, উৎকর্ষতায় কাজ করতে চাই”।

এদেশের হাজার ছাত্র-জনতা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রক্ত দিয়েছেন। সেই বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য পেশ করছি। পাশাপাশি সকল পেশার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি-উন্নত দেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এদেশের শিক্ষা এবং গবেষণা পেশা দুইটিকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় স্বায়ত্তশাসিত করা হয়েছিল। কিন্তু, বিধিবাম!!!গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বায়ত্তশাসন মোটেই পায়নি। বোর্ড অফ ম্যানেজমেন্ট থাকার পরেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আজও স্বায়ত্তশাসনের অগ্রগতি হয়নি। গবেষণায় প্রমোশন এর গতি খুবই মন্থর!! বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হতে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেতে ১২/১৫ বছর, ঊর্ধ্বতনা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হতে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে প্রায় ১২/১৫ বছর লেগে যায়। বয়স শেষ হওয়ার কারণে অনেকেই মুখ্য বিজ্ঞানী কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান না।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গবেষক হিসেবে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদটি শীর্ষ পদ। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদটি শীর্ষ পদ যার যাত্রা শুরু হয় ৩নং গ্রেড হতে। ক্রমান্বয়ে তাঁরা ২০% কোটায় পদ খালি থাকা সাপেক্ষে ১নং গ্রেডে উন্নীত হন। বিজ্ঞান শাখার প্রথম সারির ছাত্র হিসেবে যাঁরা গবেষণা পেশাকে বেছে নিয়েছেন; তাঁরা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের মত গবেষক হিসেবে ১নং গ্রেডে যেতে পারছেন না??এই প্রশ্ন এখন মেধাবীদের বলয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্মানিত উপদেষ্টা মহোদয়দের কাছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিচালক এবং মহাপরিচালক পদগুলো যথাক্রমে ২নং এবং ১নং গ্রেডে রয়েছে; কিন্তু এই পদগুলো প্রশাসনিক, নীতি নির্ধারণ প্রণয়নের জন্য, গবেষকের নয়। আমরা বিজ্ঞানী হিসেবে মর্যাদা চাই। আমরা বৈষম্য চাইনা। আমাদের প্রমোশন ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা চাই। সর্বোচ্চ ডিগ্রি পিএইচডিধারীদের সম্মান চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মত পিএইচডিধারীদের জন্য একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট চাই। বিশ্ববিদ্যালযের মত শতভাগ স্বায়ত্তশাসন চাই। বিজ্ঞানীদের মন্থর গতিময় প্রমোশন ব্যবস্থাপনা বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দ্রুত প্রমোশন/ পদোন্নতি চাই। ইউজিসির তথ্যানুসারে, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রভাষক পদ হতে ২ বছরের মধ্যেই সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক হতে ৭ বছরের মধ্যেই সহযোগী অধ্যাপক এবং তার ৫ বছরের মধ্যেই সহযোগী অধ্যাপক হতে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। পরে শিক্ষক মহোদয়গন পর্যায়ক্রমে ১নং গ্রেডে উন্নীত হন। এই প্রেক্ষিতে গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রমোশন ব্যবস্থার সংস্কার আজ সময়ের দাবি। তবেই সত্যিকারের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সার্থক-সফলতা পাবে।

এদেশের খাদ্য ও শস্য উৎপাদন-নিরাপত্তা প্রদানে, ফসল-ফলের নতুন জাত উন্নয়নে, বায়ু প্রযুক্তি উদ্ভাবনে, কৃষিতে আধুনিক যান্ত্রিকীকরণে, খাদ্য ভেজালমুক্ত করণে, সবজি-ফল-ফলাদির পোকা, রোগ এবং জীবাণু দমনে, পোস্ট হারভেস্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ও উপকারী জীবাণু উদ্ভাবনে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিজ্ঞানীদের অবদান অনুস্বীকার্য। আমাদের দেশের বহু বিজ্ঞানী Google Scholar, Pubmed Scholar হিসেবে খ্যতি রয়েছে। SC.I (Science Citation Index) Journal , Elsevier, Springer, Nature group, Science গ্রুপেও তাঁদের অসংখ্য প্রকাশনা রয়েছে। অনেকের আবার উন্নত দেশে প্যাটেন্ট/Patent রয়েছে। এত যোগ্যতার পরেও তাঁদের প্রমোশন নেই। আমার নিজের এই ধরনের প্রায় সকল গুণ থাকার পরেও দশ বছর ধরে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে রয়েছি। অনেকে আরো বেশি সময় ধরে নিজ নিজ পদে রয়েছেন। তাহলে কি করে জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮, জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ২০২০, এসডিজি ২০৩০, ডেল্টা প্লান ২১০০ বাস্তবায়িত হবে? সরকারের এই রূপরেখা বাস্তবায়নে বিজ্ঞানীরা সরাসরি অংশীদারিত্ব ভূমিকা পালন করে আসছেন।

সরকারের পরিকল্পনাগুলো উৎকর্ষ সাধনে, দেশের স্বার্থে বিজ্ঞানীদের বৈষম্য সংস্কারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। এই বৈষম্য মেধাবির জন্য একটি কষ্টকর বোঝা। দেশের জন্য বিজ্ঞানীরা কাজ করতে চায়, কাজ করে যাচ্ছে, ভবিষ্যতেও কাজ করে যাবে। যে জাতি সম্মান দিতে জানে, আল্লাহ পাক সে জাতিকে ঠকাবে না, সেই জাতির উন্নতি আসবেই ইনশাল্লাহ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই বৈষম্য অচিরেই দূর হবে।

লেখক:ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বিএআর আই
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম -৪৩৩০