ক্যাপিটালজিম ও পলিটিক্যাল স্লেভ

ড. এএইচএম সাদেক: স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিবদমান দুটি শ্রেণির মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব-সংঘাত বা সংঘর্ষ প্রকট আকার ধারণ করে তখন শ্রেণি সংগ্রাম বা শ্রেণি সংঘাত (Class struggle) অনিবার্য হয়ে যায়। অন্যায্য শাসন-শোষণ, নিপীড়ন, অসহিষ্ণু অনাচার শ্রেণি সংগ্রামের পালে গতি দেয়, বিভক্ত সমাজব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়, সভ্যতার দ্বন্দ্ব বা ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশ্যন অনিবার্য রূপ ধারণ করে।

মানুষ যখন পুঁজির দাস হয়ে যায় তখন দ্বন্দ্বের বা ক্ল্যাশের ক্ষত তত বেশি হয়। কার্ল মার্ক্স এর 'দাস ক্যাপিটাল' 'পুঁজির দাস বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় চরমভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আনাচকানাচে যুদ্ধ বাধানো বা কৃত্রিম যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব, দ্বন্দ্ব বা অসুস্থ কূটনৈতিক বলপ্রয়োগের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে এ ক্যাপিটালকে ক্যাশ করা। একটা 'কাল্পনিক চাহিদা' তৈরি করা অথচ যা মানুষের দরকার নেই, কিন্তু তারপরেও সে বস্তুর চাহিদা তৈরি করা। এই যে 'কাল্পনিক চাহিদা' এটার কোন বাউন্ডারি নেই। এর পরিসমাপ্তি অনাকাঙ্ক্ষিত, অনিবার্য ধ্বংস।

পুঁজির দাস অর্থাৎ অর্থ বা টাকার দাস হয়ে যাওয়া যে কোন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, দলের নেতা ও কর্মী বাহিনীর জন্য কতবড় আহাম্মকি কর্ম, তা কেবল নিজেদের ধ্বংসের মাধ্যমে এর শোধবোধ হয়। একটা জাতি, একটা দেশ সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী হয় বা স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নেয় যখন তার রাজনীতিতে বা রাজনৈতিক দলে অতিমাত্রায় "পলিটিক্যাল স্লেভ বা রাজনৈতিক দাস" তৈরি করা হয়। এটা একটা জাতির আত্মহননের চরমতম বিপদগামী পথ, মত ও দর্শন।

এ ধরনের ফিলোসোফির কারখানায় তৈরিকৃত প্রোডাক্ট বা কর্মী একজন স্লেভ বা আজ্ঞাবহ দাস বা সেবাদাস, যার দ্বারা না উপকৃত হবে দল, না উপকৃত হবে দেশ ও জাতি । কারন স্লেভরা নিজেকে তুচ্ছ মনে করে। মানবিক মন ও জাগ্রত বিবেক উদয়ের গতি হারিয়ে ফেলে। দিনশেষে চিন্তাচেতনায় ও আচরণে নিজেকে ভারসাম্যহীন ভাবে। আরো বিপদজনক অধ্যায় হচ্ছে ভলান্টিয়ার পলিটিক্যাল স্লেভ বা স্বেচ্ছায় রাজনৈতিক দাস হওয়া। এই "স্যাডো স্লেভ বা ছায়া দাসরা" সমাজ ও জাতির জন্য বেশি বিপদজনক ও অশনিসম্পাত।

তোষামোদি, মোসাহেবি দাসদের কারনে নেতার চারিত্রিক দৃঢ়তা স্থিরতায় বারিবর্ষণে নেতার তেজ ও ক্রেইজকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। কারন তেলবর্ষণ একপ্রকার কুইনাইন ও এন্টিবায়োটিক। ডোজ কম্পিট করতেই হবে। আর এটা মিষ্টান্নও বটে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উক্তিতো স্মরণযোগ্য - বাংগালীর বল নাই , বিক্রম নাই, বিদ্যা নাই , বু্দ্ধিও নাই । সুতরাং বাঙ্গালীর এক মাত্র ভরসা তৈল। এক তেলে চাকা ঘোরে, আরেক তেলে মন ফেরে। সুতরাং তোষামোদকারীদের ক্রমাগত তৈলবর্ষণে মন গলে, মানবিক মন তাই ভুলও হয়, ভুলও করে। এতে দেশ ও জাতির অপূরনীয় ক্ষতি হয়। যদিও মোসাহেবি দাসদের তাতে কিছু যায় আসে না।

এ ধরণের অপয়া স্লেভ বা দাসদের থেকে জাতীয় নেতা-নেত্রীবৃন্দ তথা আপামর চালিকাশক্তিদের সর্তক থাকা যেমন বাঞ্ছনীয় তেমনি কর্মীবাহিনীদের গঠনশীল চিন্তাচেতনার সুযোগ দিয়ে মননশীল দেশপ্রেমিক যোগ্য নাগরিক তৈরিতে সুযোগ দেয়াও সময়ের চাহিদা বা অপরিহার্য ।

দেশ ও জাতি কোনো মর্ডান স্লেভ বা আধুনিক দাস চায় না, চায় সুবিবেচক, সিদ্ধহস্ত, ভিশনেবল দেশপ্রেমিক ড্রাইভার। আর যদি দাসই হতে হয় তবে স্পার্টাকাস, গ্ল্যাডিয়েটর হওয়াই শ্রেয়। তা না হলে যে গলদ দিনদিন বিনির্মান হচ্ছে, তাতে আপনি আমি আমরা কি ভেবে দেখেছি আমরা কি হারাচ্ছি বা হারাতে যাচ্ছি ?

লেখক -ডেপুটি রেজিস্ট্রার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।