ড. এম মনির উদ্দিন: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি) বাংলাদেশে সব থেকে উচ্চ ফলনশীল এবং বায়োফর্টিফাইড জিংক, আয়রণ ও সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ মসুর ডালের একটি জাত; বারি মসুর-৮ উদ্ভাবন করেছে যাকে মসুরের মেগা ভ্যারাইটি নামেও অভিহিত করা হয়। বারি মসুর-৮ এ রয়েছে ২৭.৮ শতাংশ প্রোটিন এবং এই জাতটির জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন। হেক্টর প্রতি বারি মসুর-৮ এর ফলন প্রায় ২.৭ টন। এই জাতটির বীজ বপনের সময় অক্টোবর এর শেষ সপ্তাহ থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত এবং ফসল উত্তোলনের সময় মধ্য ফেব্রুয়ারী থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত।
মসুর ডাল বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য একটি পুষ্টিকর খাবার। মসুর ডাল বাংলাদেশে প্রোটিন এবং মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট এর ভালো একটি উৎস হিসেবে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে যেখানে কম আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাণিজ প্রোটিনের ক্রয়ের সামর্থ্য কম। বারি মসুর-৮ এর প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো-এটি অনেকটা কান্ড ও শিকড় পচা রোগ এবং স্টেমফাইলিয়াম বøাইট রোগ প্রতিরোধী। দ্বিতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এটি দেরীতেও বপন করা যায়। অর্থ্যাৎ বেশী জীবনকালের আমন ধান চাষের পর ডিসেম্বর এর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বপন করা যায়। এই উন্নত জাতটি দেশের মসুর ডালের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করবে।
পুষ্টি ও স্বাস্থ্যে বায়োফর্টিফাইড বারি মসুর-৮
১০০ গ্রাম কাঁচা বারি মসুর-৮ এ রয়েছে প্রচুর পরিমানে মানব শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কার্বোহাইড্রেট-২০.১৩ গ্রাম, প্রোটিন-৯.০২ গ্রাম, হজমকারী ফাইবার-৭.৯০ গ্রাম, ভিটামিন বি-৯ বা ফোলেট-২১৬-২৯০ মাইক্রো গ্রাম, আয়রণ-৭.৪০ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ-১.৩৯ মিলিগ্রাম, ফসফরাস-২৮১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি১ বা থায়ামিন-০.৮৭ মিলিগ্রাম, পটাসিয়াম-৩৬৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ বা পাইরিডক্সিন-০.২০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ বা রিবোফ্লোবিন-০.০৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৩ বা নায়াসিন-১.০৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৫ বা প্যানটোথেনিক এসিড-২.১৪ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম-৩৬ মিলিগ্রাম, জিংক-৬.১ মিলিগ্রাম, সেলেনিয়াম-৩২৫ মাইক্রো গ্রাম, ক্যালসিয়াম-১৯ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম-২ মিলিগ্রাম।
মসুর ডালে রয়েছে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন যার কারনে একে বলা হয়ে থাকে ’গরীবের সস্তা প্রোটিন’। লাল মাংসের মতো উদ্ভিদজাত এই ডালে নেই কোন ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল। প্রচুর পরিমানে প্রোটিন থাকায় মসুর ডাল পেশী, হাঁড়, ত্বক গঠন ও বজায় রাখতে সাহায্য করে। ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, স্থুলতা, হৃদরোগ, যে কোন প্রকার প্রদাহ, কোষের ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়াই, মস্তিস্কের স্বাস্থ্য বজায়, কোলোস্টেরলের মাত্রা উন্নতা করা, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রন, ফাইবার থাকায় হজমে সাহায্য করে। মাত্র ১ কাপ মসুরের ডালে ১৮ গ্রাম প্রোটিন থাকে যা ২টি ডিমের থেকেও বেশী। মসুর ডালে ফোলেট থাকে-একটি বি ভিটামিন যা লোহিত রক্তকনিকা গঠনে সাহায্য করে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মসুর ডাল চাষকারী কৃষক এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মসুর ডালের চাষ বিগত বছরগুলোর তুলনায় ক্রমান্বয়ে কমছে। এর অন্যতম কারনগুলো হলোঃ
১। বিভিন্ন ফসলের চাহিদা বেড়েছে এবং কিছু ফসল রয়েছে যা কৃষকদের জন্য মসুর ডালের চেয়ে তুলনামুলকভাবে বর্তমানে বেশী লাভজনক হওয়ায় কৃষক অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় সেই ফসল চাষে বেশী মনোযোগী হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাভজনক ফসলগুলো হচ্ছে-ভুট্টা, বিভিন্ন প্রকারের সব্জি, সরিষা ইত্যাদি।
২। কৃষক তার পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা বিবেচনায় বোরো ধান চাষকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ফলে বোরো ধান চাষ করার ফলে মসুর ডাল চাষ শস্য বিন্যাসে খাপ না খাওয়ায় কমে গিয়েছে।
বারি মসুর-৮ চাষ করা কৃষকের সাথে আলোচনার মাধ্যমে যে সকল বিষয় সর্ম্পকে জানা যায় তা হচ্ছেঃ
১। কৃষক যারা ইতিমধ্যে বারি মসুর-৮ এর চাষ করেছেন, তারা বিগত দিনের অন্যান্য সকল জাতের মসুরের চেয়ে সবচেয়ে বেশী ফলন পেয়েছেন। তারা বারি মসুর-৮ এর বিঘা প্রতি ৮-৯ মন ফলন পেয়েছেন। যদিও, কৃষক বারি মসুর-৮ এর পুষ্টিগুণ বা এটি যে জিংক ও আয়রণ বায়োফর্টিফাইড একটি ফসল তা জানেনা।
২। কৃষক বর্তমানে মসুর ডাল চাষ করতে গিয়ে প্রধান ২টি রোগের সম্মুখীন হচ্ছেন যার কারনে তারা মসুর ডাল চাষ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। তার মধ্যে প্রথমটি হলো, মসুর ডালের বীজ বপনের পর চারার বয়স ২০-৩০ দিন সময়ে চারার গোড়া পচে গিয়ে মারা যায় এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মসুর ডালের ফুল ফোটার সময়ে পাতার ঝলসে পড়া (স্টেমফাইলিয়াম বøাইট) রোগ যার ফলে মসুর ডালের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
৩। কৃষক মসুর ডাল চাষ করলে তাদের জমি ভালো থাকে, জমির উর্বরতা বাড়ে যা মসুর ডাল চাষের পরের ফসলের ফলন ভালো হয়। সেইসাথে মসুর ডালের গাছের বিভিন্ন অংশ গবাদিপশুর জন্য স্বাস্থ্যকর একটি খাদ্য হিসেবে তারা গবাদিপশুকে খাওয়ায়।
কৃষি বিজ্ঞানী এবং কৃষি কর্মকর্তাগেনের আলোচনার ভিত্তিতে বারি মসুর-৮ এর চাষ বৃদ্ধির মাধ্যমে মসুর ডালের মোট উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যে সকল সুপারিশ উঠে আসে তা নিম্নরূপঃ
১। মসুর ডালের প্রধান দুইটি রোগ বিশেষ করে গোড়া পচা এবং স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট থেকে ফসলকে রক্ষা করার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন তা হলো-
১.১। মসুর ডালের গোড়া পচা রোগের ছত্রাকের বীজানু মাটির অভ্যন্তরে অক্সিজেন কম থাকার কারনে সুপ্তাবস্থায় থাকে। তবে, যখন জমিতে ৩/৪টি চাষ দিয়ে মসুর ডালের বীজ বপন করা হয় তখন ছত্রাকের বীজানুগুলো বাইরের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে এবং দ্রæত অংকুরোদগম হয়। এ অবস্থায় মসুরের ডালের বীজ অংকুরোদগম হওয়ার পর পরই অংকুরিত ছত্রাক মসুর ডালের চারায় আক্রমন করে এবং চারার গোড়া পচে যায়। এই সমস্যা থেকে পরিত্রানের জন্য করণীয়ঃ
১.১.১। আমন ধানের পর যখন মসুর করা হয়, সেক্ষেত্রে আমন ধান কাটার মাসখানেক আগে বিনাচাষে মসুর ডালের বীজ ছিটিয়ে দেয়া। এতে, মসুর ডালের বীজ অংকুরিত হয়ে ধানের গোড়া বেয়ে লম্বা হবে এবং ধান কাটার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা গ্রহন করলে মসুরের ভালো ফলন পাওয়া যাবে। অধিকন্ত, এতে জমি চাষ না দেওয়ায় মসুর ডালে গোড়া পচা রোগ দেখা দেয়না।
১.২। মসুর ডালের গুনগত মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করতে হবে। কৃষক পর্যায়ে বীজ রোগবিহীন জমি থেকে সংগ্রহ করে সঠিকভাবে শুকিয়ে পলিথিন ব্যাগ বা টিনের পাত্রে ভালোভাবে রাখতে হবে যাতে বীজে কোন পোকা আক্রমন না করে এবং বীজের আদ্রতা না বাড়ে। কখনো সাধারনভাবে রাখা অবীজ ব্যবহার করা যাবেনা।
১.৩। মসুর ডালের বীজ বপনের আগে অবশ্যই বীজ শোধনকারী ছত্রাকনাশক যেমন প্রোভেক্স, ভিটাভ্যাক্স দিয়ে শোধন করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে, বীজ শোধনের জন্য প্রোভেক্স যাতে বীজের সাথে ভালভাবে লেগে থাকে তার জন্য ভাতের মাড় দিয়ে বীজ প্রোভেক্স মিশালে ভালভাবে মিশানো হবে। এক্ষেত্রে, শোধন করা বীজ বপন করার ১ মাস পর আবার প্রয়োজনে প্রোভেক্স বা অন্য কোন ছত্রাকনাশক বিকালে জমিতে স্প্রে করে দিতে হবে যাতে রাতের কুয়াশার মাধ্যমে ছত্রাকনাশক গাছের গোড়ায় পড়ে।
১.৪। বারি মসুর-৮ অনেকটাই স্টেমফাইলিয়াম বøাইট রোগ প্রতিরোধী একটি জাত। ফলে, এই জাতটিতে সাধারনত মসুর ডালের ফুল ফোটার সময় বভ। ব্লাইট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে, অন্যান্য জাতের বেলায় সঠিক ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে এই রোগটি সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।
১.৫। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় মসুর ডালের জমিতে অবশ্যই ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা প্রয়োজন যাতে গাছের কোন ক্ষতি না হয়।
১.৫। মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে, মসুর ডাল সরিষা, তিসি, রাই সরিষা, গম, বার্লি ইত্যাদি ফসলের সাথে মিশ্রচাষ এবং আখের সাথে সাথী ফসল করলে রোগের প্রাদুর্ভাব কমে যায় এবং মোট উৎপাদন বেড়ে যায়।
২। বারি মসুর-৮ এর ফলন বাড়ানোর জন্য এবং কৃষকের জন্য ডাল চাষ লাভজনক করার জন্য ইনোকুলাম ব্যবহার করার উপর জোর দেয়া হয়।
৩। মসুর ডাল চাষের আওতায় যেহেতু চাষের এলাকা দিন দিন কমে যাচ্ছে সেহেতু মসুর ডালের উচ্চ ফলনশীল জাতের প্রবর্তনের মাধ্যমে মোট উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দ্যোগ গ্রহন করতে হবে। আর, এজন্য বারি মসুর-৮ বর্তমানে দেশের একমাত্র মেগা ভ্যারাইটি যার ফলন সব্বোর্চ্চ। কাজেই, বারি মসুর-৮ এর চাষ সম্প্রসারণ করার প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
৪। বরেন্দ্র এলাকার মোট প্রায় ৩,০০০ গভীর নলকুপের মধ্যে ইতিমধ্যে কয়েক শত অকেজো হয়ে পড়েছে। অর্থ্যাৎ পানির স্তর অত্যধিক নীচে নেমে যাওয়ায় আর পানি উঠছেনা। পাশাপাশি, বরেন্দ্র এলাকার চালু থাকা গভীর নলকুপগুলো থেকে ৫০ শতাংশের কম পানি উঠানো সম্ভব হচ্ছে এবং এর কারনে বোরো ধানের জমিতে প্রয়োজনীয় সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। ফলে, বোরো ধানের ফলন অত্যন্ত কম পাওয়া যাচ্ছে যা কৃষকের জন্য মোটেই লাভজনক হচ্ছেনা।
এমতাবস্থায়, বরেন্দ্র এলাকায় বোরো চাষ কমিয়ে আনতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ও লাভজনক অন্যান্য ফসলের মাধ্যমে শস্য বিন্যাস তৈরী করতে হবে এবং এই শস্যবিন্যাসের মধ্যে মসুর ডালকে অর্ন্তভুক্ত করে মসুরের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে। সেইসাথে, বরেন্দ্র এলাকার ধানের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে উচ্চ ফলনশীল আউশ ও আমনের এলাকা বাড়াতে হবে। এর ফলে সকল ফসলে সম্পুরক সেচের মাধ্যমে নির্বাচিত সকল ফসলের হেক্টর প্রতি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে এবং কৃষকের আয় বেড়ে যাবে।
৫। পরিকল্পিত উপায়ে বরেন্দ্র এলাকায় উচ্চ ফলনশীল, বায়োফর্টিফাইড জিংক ও আয়রণ সমৃদ্ধ বারি মসুর-৮ এর সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের মসুর ডাল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি খরাপ্রবন এই এলাকার মানুষের শরীরের প্রয়োজনীয় জিংক ও আয়রণের ঘাটতি পুরনে অনেকটাই সহায়ক হবে।
৬। বরেন্দ্র এলাকার জন্য ক্রপ জোনিং করে জলবায়ু বান্ধব, ভু-গর্ভস্থ পানির স্বল্পতা বিবেচনায় সম্পুরক সেচ ও পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরন, কৃষকের জন্য লাভজনক ও চাহিদা অনুযায়ী শস্য নির্বাচন, এবং ফসলের নিবিড়তা বাড়ানোর মাধ্যমে জমি থেকে মোট উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সময়োপযোগী শস্যবিন্যাস তৈরী করে তা অনুসরন করে শস্য উৎপাদন নিশ্চিত করা যেখানে ডাল ফসল অর্ন্তভুক্ত করা যাতে জমির উর্বরতা এবং উৎপাদন ক্ষমতা দুটিই বাড়ে।
৭। যশোর এবং ফরিদপুর অঞ্চলে বারি মসুর-৮কে অর্ন্তভুক্ত করে কৃষকের জন্য লাভজনক শস্যবিন্যান তৈরীর সুযোগ রয়েছে এবং বারি মসুর-৮ এর উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে এই দুইটি অঞ্চলে।
বারি মসুর-৮ এ নাইট্রোজেন ফিক্সেশন
নাইট্রোজেন ফিক্সেশন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে লিগিউম শস্য এবং নির্দিষ্ট রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া একসাথে কাজ করে গাছের জন্য শিকড়ের চারপাশের মাটির বাতাস থেকে নাইট্রোজেন তৈরী করে। ফসলের বীজ অংকুরিত হওয়ার পরপরই রাইজোবিয়া মুলের লোম বা চুলে প্রবেশ করে। এভাবে রাইজোবিয়া গাছের শিকড়ের মধ্যে দ্রæত সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং উদ্ভিদ নোডিউল নামক বিশেষ কাঠামো তৈরী করে প্রতিক্রিয়া জানায়, যেখানে রাইজোবিয়া থাকে। মুলের সংক্রমন এবং নোডিউল গঠনের প্রক্রিয়াটিকে নোডুলেশন বলা হয়। মসুর বীজের অংকুরোদগমের তিন থেকে চার সপ্তাহ সময় লাগতে পারে গাছের শিকড়ে নোডুলেশন স্পষ্ট হওয়ার জন্য।
মাটির ছোট ছিদ্রে থাকা বাতাসে গ্যাসীয় আকারে প্রায় ৮০ শতাংশ নাইট্রোজেন থাকে এবং এই নাইট্রোজেন গাছের জন্য গ্রহনযোগ্য নয়। যাই হোক, মুল নোডিউলের রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেনের সাথে আবদ্ধ হয়ে নাইট্রেট গঠন করে নাইট্রোজেন গ্যাসের এই রুপটিকে ঠিক করতে পারে যা গাছের ব্যবহারের জন্য গ্রহনযোগ্য।
বারি মসুর-৮ চাষে ইনোকুলেশন ব্যবহার
রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া ধারনকারী পণ্যগুলিকে ইনোকুল্যান্ট বলা হয়। ইনোকুলেশন হচ্ছে সফল নোডুলেশন নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট পরিমানে মাটিতে উপযুক্ত রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া প্রবর্তন করার প্রক্রিয়া। কমার্শিয়াল ইনোকুল্যান্ট যখন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় তখন প্রতিটি গাছ পর্যাপ্ত সংখ্যক রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে আসে এবং নোডুলেশন শুরু হয়ে নাইট্রোজেন ফিক্সেশন প্রক্রিয়া শুরু করে। রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া মাটিতে খুব বেশী গতিশীল নয় এবং এইভাবে শিকড়ের লোমগুলোর সংক্রমন ঘটার জন্য ইনোকুল্যান্টকে বিকাশমান চারার সংস্পর্শে আসতে হয়।নির্দিষ্ট ডাল ফসলের জন্য নির্দিষ্ট রাইজোবিয়াম প্রজাতির দরকার হয়। যেমন মসুর ডাল ফসলে নোডুলেশন করতে সক্ষম একটি রাইজোবিয়াম প্রজাতি ছোলাতে নোডুলেশন করতে সক্ষম নয়। নাইট্রোজেন ফিক্সেশন প্রক্রিয়াকে অনুকুল করার জন্য মাটিতে সাধারনত পর্যাপ্ত সংখ্যক সঠিক রাইজোবিয়াম থাকেনা।
নাইট্রোজেন ফিক্সেশন শুরু না হওয়া পর্যন্ত ডাল ফসলের চারা মাটির উপরের ১৫-৩০ সেমি. স্তর থেকে নাইট্রোজেন ব্যবহার করে। এই গভীরতার নীচে থেকে ছোট চারা নাইট্রোজেন গ্রহন করতে পারেনা। নাইট্রোজেন ফিক্সেশন ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে তিন থেকে চার সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। এই সময়ের জন্য ডাল ফসলের উচ্চ ফলন নিশ্চিত করার জন্য হেক্টর প্রতি ৩৫-৪০ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে যেতে পারে। বিশেষ করে, যে মাটিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা ১১ কেজি/হেক্টর এর কম থাকে, সেখানে গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধি ধীর হতে পারে এবং গাছের চারা হলুদ হয়ে যেতে পারে যার কারনে বীজ বপনের সময় কম মাত্রায় ইউরিয়া দরকার হয়।
গাছের বিকাশ, নোডিউল গঠন এবং নাইট্রোজেন ফিক্স করার জন্য ডাল ফসলে অবশ্যই ফসফরাস থাকতে হবে। সেজন্য মসুর ডালের উচ্চ ফলনের জন্য জমিতে ফসফেট সার দেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জমিতে ডিএপি সার ব্যবহার করলে আলাদা করে ইউরিয়া সার দেয়ার দরকার নেই। কারন, ডিএপি সারে ফসফরাস ও নাইট্রোজেন দুটোই থাকে। রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ফিক্স করা নাইট্রোজেনের প্রায় সবটুকুই সরাসরি গাছে চলে যায়। তবে, কিছু নাইট্রোজেন পরবর্তী নন-লিগিউম ফসলের জন্য মাটিতে লিক বা হস্তান্তর হতে পারে (ওয়ালী এট অল, ১৯৯৬) এবং এর পরিমান ১৩.৬১-২২.৬৮ কেজি নাইট্রোজেন/হেক্টর। ইনোকুলেটেড মসুর ডাল গাছ জমিতে হেক্টরে প্রায় ১৫৬ কেজি নাইট্রোজেন (৩৪০ কেজি ইউরিয়া সার) ফিক্সেশন করতে পারে। যার ফলে মসুর ডালের ফলন প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হয়না।
যেহেতু, দেশে মসুর ডালের চাষ কমছে এবং এর কারনে আমাদের বছরে প্রায় ৫-৬ লাখ টন মসুর ডাল আমদানী করতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে মসুর ডালের উৎপাদন প্রায় ২ লাখ টন। আগামীদিনে দেশে মসুর ডালের চাহিদা আরো বেড়ে যাবে এবং মসুর ডাল যেহেতু একটি উদ্ভিজ্জ্য প্রোটিনের একটি অন্যতম উৎস। তাই, মসুর ডালকে আমরা গরীবের আমিষও বলে থাকি এবং কৃষক পরিবারগুলোতে মসুর ডালের গ্রহন বাড়ানোর জন্য এর চাষ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহন করা প্রয়োজন। বিশেষ করে, গেøাবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন) বাংলাদেশ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং বিএডিসি যৌথভাবে বারি মসুর-৮ এর সম্প্রসারণে ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছে। তাই আশা করা যায়, জিংক ও আয়রণ সমৃদ্ধ বায়োফর্টিফাইড বারি মসুর-৮ এর সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের জিংক ও আয়রণের ঘাটিতি মোকাবেলায় সহায়ক হবে।
লেখকঃ এগ্রোনমিস্ট অ্যান্ড কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ