সমীরণ বিশ্বাসঃ ধনে প্রান ধানে ধন, ধানে জ্ঞান সভ্যতা বিস্তার। ফসল চাষের জন্য বীজ লাগে। এ সত্যটি আবিষ্কারের সাথে সাথে মানব সভ্যতা, যা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আস্তে আস্তে এগুচ্ছিলো, তা যেন অগ্রগতির চলন্ত সিঁড়িতে পা দিল। যা চড়াই উৎরাই এর খাঁজে খাবি খাচ্ছিলো তা যেন নৌকার পালে বাতাস লাগলে নৌকা যেভাবে এগোয় তেমনি তরতর করে এগুতে লাগলো। সভ্যতার অগ্রগতি দ্রুততর হলো; সহজতর হলো।
যে দিন নিরাপত্তাহীন শিকারভিত্তিক জীবনযাপন ক্লান্ত মানুষ পরবর্তী ফসল চাষের জন্য বীজ রেখেছিলো সেদিনই সে মানবতার কল্যাণ সাধনের মস্ত বড় পথ আবিষ্কার করেছিলো। বীজ মানুষের সাথে এবং তার সভ্যতার অগ্রগতির সাথে এই যে সম্পৃক্ততা অর্জন করলো তা আজ অবধি চলছে। সম্পৃক্ততা ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে এবং আগামীতে এ ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই থাকবে। এ সত্য আবিষ্কারের কাল বা যেদিন মানুষ তার প্রয়োজনের ফসল চাষের জন্য বীজ রেখে ছিলো এ সময়টি সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। বিভিন্ন তথ্য এবং উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় এখন থেকে প্রায় হাজার দশেক বছর আগে পৃথিবীতে কৃষিকাজ শুরু হয়েছিলো। তাই ধরা যায় ১০,০০০ বছর পূর্বের দিকের কোন এক সময় মানুষের সাথে এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে বীজের সম্পৃক্ততার শুরু হয়েছিলো।
বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিকাজ ও নিজের খাদ্য সংগ্রহ করতে শিখে মানুষ যেন রাতারাতি সভ্য হয়ে গেল। নিজের উৎপাদিত খাবার পাওয়াতে সে বনে জঙ্গলে ঘোরা ছেড়ে দিলো। একখানে জলাশয়ের পাশে স্থায়ী হয়ে আস্তানা গড়লো। খাবার সংগহের সার্বক্ষণিক চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে সে অন্য চিন্তার অবকাশ পেলো এবং অন্য চিন্তা থেকে শুরু হলো সভ্যতার স্তর থেকে স্তরান্তে উত্তরণ।
খাবার নিশ্চিত হবার পরপরই সে চিন্তা করলো একটা থাকবার জায়গার। জায়গা নির্দিষ্ট করে সে বেড়া দিলো এবং ছাউনি দিল। এভাবে সে নির্মাণ করলো তার ঘরবাড়ি। সে চিন্তা করলো নিরাপত্তার। সে তার বাড়ি সুদৃঢ় করলো। তার কৃষিকাজের জায়গায় সীমানা চিহ্নিত করলো। আস্তে আস্তে গড়ে উঠলো পরিবার; পরিবার থেকে জনপদ এবং শেষে দেশ। ব্যবস্থাপনার জন্য সৃষ্টি হলো সমাজ। ধরে নেয়া যায় এমনি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সভ্যতা অগ্রসর হলো যার শুরু হয়েছিলো বীজ আবিষ্কারের মাধ্যমে।
সম্ভবত দানাশস্যের চাষ দিয়ে কৃষি এবং সভ্যতার শুরু হয়েছিলো; যখন মানুষ জানতে পারলো এক ধরনের ঘাস বীজ জাতীয় গাছের বীজ বপন করলে তা থেকে অনেক বীজ হয়। উৎপাদিত বীজ খাওয়া যায় এবং তা পরবর্তী ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা যায় তখন সে খাদ্যের অন্বেষণে ঘোরাঘুরি বন্ধ করে স্থায়ী হয়ে বসবাস শুরু করলো।
মানবতিহাসের সব বড় সভ্যতাই এরূপ ঘাস জাতীয় গাছ হতে উৎপাদিত দানাশস্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিলো। কারণ দানাজাতীয় শস্যের খাদ্যমান বেশী এবং সংরক্ষণ সুবিধাও বেশী। তাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর অববাকিায় মেসোপটেমিয়ানরা গমের আবাদ করতো। হোয়াংহো ও ইয়াংজী নদীর অববাহিকায় চীনারা ধান উৎপাদন শুরু করেছিলো। ইউকানান অঞ্চলের শুকনো সমতল এলাকায় মায়ারা ভূট্টা উৎপাদন করতো। বীজ অতীতকালে এবং এখনও মানুষের প্রধান খাদ্য উৎপাদনের উৎস। বীজ না থাকলে কৃষিকাজ শুরুই করা যেতো না এবং কৃষিকাজকে স্থিতিশীল করা সম্ভব হতো না। সভ্যতার বিকাশ সাধন কৃষিকাজের অস্থিতিশীলতার কারণে বিঘিœত হতো এবং গতি শ্লথ হয়ে পড়তো। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে বীজের গুরুত্ব অত্যন্ত গভীরভাবে উপলব্ধি করা যাচ্ছে এবং বীজ ব্যবহারের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
বীজের গুরুত্ব
বীজের অন্তনির্হিত ক্ষমতা ও বীজের বিভিন্ন ব্যবহার বীজকে একটি অনন্য সাধারণ এবং অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যে পরিণত করেছে। নিম্নে বর্ণিত বিষয়াদির আলোচনা থেকে বীজের গুরুত্বের দিক ও মাত্রা সম্পর্কে একটি ধারণা করা যেতে পারে।
অস্তিত্ব : অসম্ভব বিষয় নিয়ে কিছু সময় চিন্তা করা যাক। ধরে নেয়া যাক পৃথিবীতে বাতাস নেই বা পৃথিবীর বাতাস সব দূষিত হয়ে গেছে বা পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ সামান্য বেড়ে গেছে বা কমে গেছে। অথবা পৃথিবীর পানি সব উধাও হয়ে গেছে বা দূষিত হয়ে গেছে। এর যে কোন একটি ঘটলে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে এবং বেশীদিন এ ধরনের বিরূপ অবস্থা বিরাজ করলে আমাদের তথা সমস্ত জীবের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এখন আমরা চিন্তা করি বীজ নিয়ে। পৃথিবীতে বীজ নেই বা সব বীজ মরে গেছে। তাহলে কি ঘটবে। পৃথিবীতে গাছ বিলীন হয়ে যাবে। বাতাস, তাপ বা পানি এদের প্রাচুর্য কোন সময় আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করে না যে এমনটি ঘটতে পারে। বীজের বেলায়ও একথা সত্যি। গাছ প্রচুর বীজ উৎপাদন করে এবং এর প্রাচুর্যের কারণে মনে হয় না যে বীজ কোনদিন নিঃশেষ হবে। বীজে কোন বিরূপ ঘটনা ঘটলে আমাদের অস্তিত্বের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই বলা যায় বীজের প্রতি অবহেলা আমাদের অস্তিত্বের প্রতি অবহেলার সামিল।
চাষ শুরু: অতীতে যেমন বীজ না হলে কৃষিকাজ শুরু সম্ভব হয়নি আজও তেমনি চাষ শুরু করতে চাইলে বীজের কথা ভাবতে হয়। বীজ অথবা চারা সংগ্রহ করতে পারলেই কেবল চাষ শুরু করা যায়।
প্রযুক্তির বিস্তার : বীজ শুধু চারা উৎপাদনকারী বা ফসল উৎপাদনকারীই নয়, বীজের মধ্যে গবেষণালব্ধ বহু প্রযুক্তি প্রবিষ্ট করানো থাকে। অর্থাৎ গবেষণা করে বীজ উচ্চফলনশীল করা হয়। অথবা রোগ ও পোকা প্রতিরোধকারী বানানো হয়। আবার কোন স্থানের ফসলক্রমের উপযোগী করার জন্য আগাম বা নাবী বপন করা যায় এমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বীজ উদ্ভাবন করা হয়। এ সমস্ত গুণাবলীসহ বীজ যখন কৃষকের কাছে যায় তখন শুধু বীজই তার হাতে পৌঁছায়না, গবেষণাগার থেকে উদ্ভূত এ সমস্ত প্রযুক্তির ফলাফলও তার কাছে পৌঁছায় এবং প্রযুক্তির বিস্তার ঘটে।
অন্য উপকরণের ফলপ্রসূতা : ফসলের ফলন বৃদ্ধির জন্য সার, সেচ, কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বীজ যদি উচ্চফলনশীল না হয় তখন সার, সেচ বা কীটনাশক যতই ব্যবহার করা হোক না কেন বেশী ফলন পাওয়া কোন মতেই সম্ভব হয় না। অপরদিকে উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার না করে অন্য উপকরণ ব্যবহার বৃদ্ধি করলে কোন ফল লাভ ঘটে না বরং অর্থের অপচয় ঘটে। অন্য উপকরণের ব্যবহার ফলপ্রসূ করতে উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার অপরিহার্য।
বীজের ব্যবহার:বীজের গুণাবলী এবং বৈশিষ্ট্যসমূহ বীজকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের অতি প্রয়োজনীয় অসংখ্য কার্য সম্পাদনে বীজ ব্যবহৃত হয়। তাই উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের জন্য বীজের গুরুত্ব অপরিসীম।
বংশবিস্তার : গাছের অংশ বিস্তারের প্রধান মাধ্যম হলো বীজ। বীজ উৎপাদন না করতে পারলে একটি গাছ তার বংশধর রেখে যেতে পারতো না। বীজ ভ্রƒণকে নানাবিধ প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা হতে রক্ষা করে। উপযুক্ত সময়ে ভ্রƒণকে খাদ্য সরবরাহ করে চারায় রূপান্তরিত করে, পারে যা গাছে রূপান্তরিত হয়। বীঝ ভ্রƒণকে পরবর্তী উৎপাদন কাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখে। অনেক বীজ বহুদিন পর্যন্ত জীবিত থাকে। বীজ না থাকলে পৃথিবী থেকে গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। সাথে সাথে ঐ সমস্ত গাছের উপর নির্ভরশীল প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হতো।
খাদ্য : বীজ পশু-পাখির প্রধান খাদ্য। মানুষের খাদ্যের মধ্যে দানাশস্যের বীজ সর্বপ্রধান। পৃথিবীতে গাছের বীজ, যে কোন উদ্ভিদ এবং প্রাণীজ দ্রব্য হতে বেশী খাদ্যের জোগান দেয়। গমের বীজ খাদ্য হিসেবে প্রথম স্থানে এবং ধানের বীজ দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। ভুট্টা, বার্লি, জোয়ার, বাজরা, ডাল, তৈলবীজ ইত্যাদি ফসলের বীজ মানুষের এবং পশুপাখির খাদ্য। আমাদের দেশে দানাশস্য বিশেষ করে ধানবীজ মানুষের শরীরের তিন চতুর্থাংশ শক্তি সরবরাহ করে থাকে অর্থাৎ আমরা যে চলাফেরা কাজকর্ম করছি সবই আসছে ধানবীজ থেকে।
উদ্ভিদের জাত উন্নয়ন : বীজ উদ্ভিদের জাত উন্নয়নের একটি ইতিহাস। মানুষ ভাল জাত দেখে বীজ সংরক্ষণ করছে এবং তা থেকে পরবর্তীতে ফসল উৎপাদন করছে। এভাবে বীজের মাধ্যমে ভাল জাত বাছাই অতীতে শুরু হয়ে অদ্যাবধি চলছে। অনেক সময় বলা হয় বীজের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন হয়। অবশ্য অংগজকোষে মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন জাত সৃষ্টি হয়েছে এবং অংগজ বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে তা পৃথিবীতে টিকে রয়েছে। কিন্তু এ ব্যবস্থার জন্য বসে থাকতে হতো অনেক সময় ধরে এবং ফলাফল ছিল অনিশ্চিত। অন্যদিকে অন্যদিকে কোন জাতে ভাল গুণ দেখা গেলে তা শংকরায়ণের মাধ্যমে ইপ্সিত জাতের মধ্যে প্রবিষ্ট করার মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করে জাত উন্নয়ন করা হচ্ছে। বীজের গঠন ও বেঁচে থাকার ক্ষমতার কারণে প্রজননবিদগণ বহু গাছের অল্প পরিমাণ জাত প্রতিকূলতা নিয়ন্ত্রণপূর্বক সংরক্ষণ করতে পারেন। প্রতিকূলতা নিয়ন্ত্রণকারী এ জায়গায় অর্থাৎ জিন ব্যাংকে বীজ রেখে পরবর্তীতে জাত উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা হয়। ভাল জাতের গাছ উদ্ভাবনের প্রচেষ্টায় বীজ এভাবে মানুষকে সাহায্য করে চলেছে।
ফসল উৎপাদন : বীজ ছাড়া ফসল উৎপাদনের কথা চিন্তাই করা যায় না। ফসল উৎপাদনের শুরুই হচ্ছে বীজ। অন্যদিকে বীজ যদি ভাল গজানোর ক্ষমতা সম্পন্ন না হয় তাহলে মাঠে গাছের সংখ্যা কম হবে এবং তাতে ফসল কম হবে। আবার বীজ যদি উচ্চফলনশীল না হয় তাহলে সার প্রয়োগ করে সেচ দিয়ে এবং রোগ-পোকা-মাকড় দমন করেও উচ্চফলন পাওয়া সম্ভব হয় না। অর্থাৎ বীজ উচ্চফলনশীল না হলে অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার অর্থের অপচয় ঘটায়। সরাসরি বলা যায় বীজ না থাকলে বেশীর ভাগ ফসল উৎপাদনই সম্ভব হতো না।
কাঁচামাল : শিল্প দ্রব্য উৎপাদনের বীজ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রসাধন শিল্পে তৈল জাতীয় বীজ বহুল পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। নানাবিধ রাসায়নিক দ্রব্য তৈরির কাঁচামাল হচ্ছে দানা শস্যবীজ ও তৈলবীজ। মাদক জাতীয় পানীয় তৈরীতে গম, বার্লি, ধান ব্যবহৃত হয়। অনেক ঔষধের অন্যতম প্রধান উপাদান বীজ।
সৌন্দর্যের আধার : বীজের আকার, আকৃতি, রং ইত্যাদি অত্যন্ত সুন্দর। একেকটি বীজ একেক আকারের। তামাকের বীজ বা গোল আলুর প্রকৃত বীজ অত্যন্ত ছোট; ডাঁটার বীজ তা থেকে একটু বড়। নারিকেলের বীজ বা তালের বীজ আকারে বেশ বড়। আকৃতির কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় কোনটি গোল কোনটি চ্যাপ্টা, কোনটি ডিম্বাকৃতি। বীজের রং বীজকে সৌন্দর্য্যরে আধারে পরিণত করেছে। হরেক রং এর সংমিশ্রণে বীজ যেন শিল্পির আঁকা নয়নাভিরাম এক ছবি। বীজের সৌন্দর্য্য মানুষের মনের খোরাক জোগায়।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।