বাহলুল আলমঃ “ইন সলিডারিটি ফর আ গ্রিন ওয়ার্ল্ড” আজারবাইজানের রাজধানী বাকু এই মুহূর্তে জলবায়ু কর্মীদের পদচারনায় মূখরিত। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে শহরের আনাচকানাচে যেখানে যাবেন; দেখবেন আজারবাইজান সরকারের জলবায়ু প্রীতি। একটি সবুজ বিশ্বের জন্য সংহতি’ ব্যানার ফেষ্টুন, প্লাকার্ডে মূখরিত। অথচ এই আজারবাইজানই জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম নিয়ামক জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদক। আজারবাইজানের অর্থনীতির প্রায় অর্ধেক তেল এবং গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। আর দেশটির রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশও আসে তেল-গ্যাস থেকে। আয়োজকেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে অন্যদের অবস্থাও অনুমেয়। গত কপ২৮ সম্মেলনেরও একই অবস্থা সংযুক্ত আরব আমিরাত (দুবাই) এর অর্থনীতি ৫০ শতাংশ নির্ভর করে জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর।
১১ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখ থেকে ২০২৪ আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বসছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন এর কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ' এর ২৯তম আসর, চলবে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত। ১৯৭টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ১৯৮টি পক্ষ নিয়ে কপ জলবায়ু সম্পর্কিত নীতি ও অর্থায়ন বিষয়ে আলোচনার জন্য এটি একটি বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ফোরাম। এখানে সবাই রাজা। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। বরঞ্চ কে কীভাবে লাভবান হবে তার প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকে। জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা করতে ৩২ হাজার মানুষের (কূটনীতিক, সাংবাদিক, জলবায়ু বিজ্ঞানী, এনজিও, অ্যাক্টিভিস্ট এবং আদিবাসী নেতারা) সমাবেশ হতে যাচ্ছে এই সম্মেলনে। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নের পক্ষে কাজ করতে এ-সম্মেলনের বাহিরে থাকবে না।
'কপ' মানে 'কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ'। এটি জাতিসংঘের একটি উদ্যোগ। ১৯৯৫ সালে কপের প্রথম সম্মেলন হয়। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ ইস্যুটি প্রথমবারের মতো সামনে আসে। কিন্তু আমাদের দেশ তথা বাংলাদেশের ১৯ টি উপকূলীয় জেলার ৭১০ কিলোমিটার এলাকার উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ জানে-না “কপ’’ কী? কিন্তু তারা জানে, তাদের ওখানে প্রতিবছর দুর্যোগ আঘাত হানছে, লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে, তাপদাহ বাড়তেছে, খরা বৃদ্ধি পাচ্ছে, নিরাপদ পানির সুযোগ কমে যাচ্ছে, বাড়ছে কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া অপরিণত শিশু, বাড়ছে নারীদের গর্ভধারণ ও প্রসব সংক্রান্তসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতার হার। মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, শস্যের গুণাগুণ ও উৎপাদনে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন নতুন রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। কৃষিতে কীটনাশক ও সারের প্রয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি জমিতে সেচের ব্যাপকতা বাড়ছে। রাসায়নিকের ব্যাপক ব্যবহার পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দরিদ্রতা বাড়ছে, মানুষ জীবিকার আশায় অন্যত্র চলে যাচ্ছে। মানুষের জীবন-জীবিকার উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে, ঘরবাড়িসহ অবকাঠামো-গাছপালা-ফসল ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, দারিদ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে, বিশেষ করে নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীরা অধিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, বাল্যবিবাহ বহুবিবাহ, শিশুমৃত্য, ডিভোর্স এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রয়েছে বজ্রপাতের প্রকোপ এবং কালবৈশাখীর ছোবল। এছাড়াও অস্বাভাবিক তাপ ও শৈত্যপ্রবাহ তো আছেই। করোনা, এমপক্স, হাম-রুবেলা, ডেঙ্গু সহ নতুন-নতুন রোগের আবির্ভাব হচ্ছে।
আজারবাইজানে এবারের জলবায়ু সম্মেলন বহুবিধ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এবারের সম্মেলনে আলোচ্য সূচির শীর্ষে রয়েছে অর্থায়ন। এ নিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ আরো বেশী। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজণিত কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ জন্য উন্নত বিশ্ব কী পরিমাণ অর্থায়ন করে তা দেখার জন্য। তাছাড়া বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ তাই এবারে সম্মেলনের অপেক্ষা করছিল, যে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ট্রিলিয়ন ডলারের চাহিদার কতটা পূরণ করে তা দেখার জন্য। অন্যদিকে বছরের রেকর্ড উষ্ণায়ন, তাপপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিমাত্রায় বরফ পড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে আলোচনার ইস্যুগুলোতে।
এবারের কপ সম্মেলন নিয়ে রয়েছে বহু আশংকা,
● ২০০৯ সাল থেকে উন্নত বিশ্ব ঐকমত্য ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২০২০ সাল থেকে জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেবে; কিন্তু প্রকৃত অর্থে বছরে এখন মাত্র ২০-২২ বিলিয়ন ডলারের মতো দিচ্ছে যদিও দাবি করা হচ্ছে, তারা বছরে ৮০ বিলিয়ন বা ততধিক ডলার দিচ্ছেন।
● চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে মনোযোগী হলেও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার অব্যাহত রাখা নিয়ে সমালোচনার মুখে রয়েছে।
● সৌদি আরবসহ আরব রাষ্ট্রগুলো সবুজায়ন প্রকল্প গ্রহণ করলেও আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলে তাদের ভূমিকা সীমিত।
● যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আসছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতি বিষয়ে প্রেসিডেন্টের জেষ্ঠ্য উপদেষ্টা জন পোডেস্তার নেতৃত্বে ২০টিরও বেশি বিভাগ, সংস্থা ও সংস্থার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে। বাইডেন প্রশাসনের প্রতিনিধি দল আলোচনায় অংশ নিলেও কোনও স্পষ্ট আর্থিক প্রতিশ্রুতি দিতে পারবে না। কারণ ট্রাম্প জানুয়ারি থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘ধাপ্পাবাজি’ বলে অখ্যায়িত করা । যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়া একের পর এক বৈশ্বিক নেতার অনুপস্থিতির খবরও হতাশা ছড়িয়েছে।
● চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁও বাকু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেন।
ফলে রথী–মহারথীহীন বাকু প্রাক্–শিল্পায়ন যুগের মতো তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখার অঙ্গীকারটুকু পর্যন্ত রক্ষা করতে পারবে কি না, সেই সন্দেহের ঢেউ বইছে সম্মেলন শুরুর আগে থেকেই। জি-২০ জোটের মাত্র কয়েকজন নেতা এই সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন অথচ যোগ দেওয়ার কথা সকলেরই। কারন বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮০ শতাংশই এই জোটের দখলে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশের সঙ্গে জড়িত জি-২০ জোটের দেশগুলো। আবার বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী যে গ্রিনহাউস গ্যাস, তার প্রায় ৮০ শতাংশই এই জোটভুক্ত দেশগুলো নির্গমন করে। অথচ তারাই অনুপস্থিত।
গত ২০২৩-এ বিশ্বে নির্গত কার্বনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ৬০ বিলিয়ন টন। চলতি বছর কার্বন নির্গমনের এই রেকর্ড ভেঙে যাবে। প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে ৫০ শতাংশ বেশি কার্বন অবস্থান করছে। গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ-২৮ এ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়ে একটি বৈশ্বিক সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল। সকল অংশগ্রহণকারী দেশ থেকে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানের (এনডিসি) বিষয়ে চুক্তির বিষয়টি এবারের আলোচ্যসূচিতে শীর্ষে থাকার কথা। (এনডিসি হলো একটি দেশের জাতীয় জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা, যা প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে)। এনডিসিগুলো অবশ্যই প্রতি পাঁচ বছরে হালনাগাদ করতে হয়।
বিশ্বের ১৩০টি দেশের ১ হাজার ৯০০ নাগরিক সমাজ সংগঠনের ফোরাম ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’–এর নির্বাহী পরিচালক তাসমিন ইসপ তাঁদের প্রত্যাশার কথা দৃপ্তভাবে জানিয়ে দিয়ে বলেছেন, পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে বছরে একনাগাড়ে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। অথচ -২০০৯ সাল থেকে ঐকমত্য ছিল, উন্নত বিশ্ব উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২০২০ সাল থেকে জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেবে; কিন্তু প্রকৃত অর্থে বছরে এখন মাত্র ২০-২২ বিলিয়ন ডলারের মতো দিচ্ছে যদিও দাবি করা হচ্ছে, তারা বছরে ৮০ বিলিয়ন বা ততধিক ডলার দিচ্ছেন।
প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ-২১-এ যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে (১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত রাখা) সব দেশ একমত হয়েছিল তা ক্রমাগতভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। কেউ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমায়নি কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির সব কোম্পানি তাদেরই। কপ সম্মেলনে তাদের উপস্থিতি এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে আশঙ্কা রয়েছে তা বাস্তবে পরিণত হতে যাচ্ছে। গঠন হয়েছে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড, গৃহীত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়ন (জিএসটি) প্রতিবেদন আর অন্যদিকে এবারো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়ে একমত হননি বিশ্বনেতারা।
এবারের সম্মেলনে এটাই প্রথম চাওয়া ছিল ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত টার্গেট রাখা। পাশাপাশি ছিল ক্লাইমেট ফাইন্যান্স বা লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠন করা। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়টি খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অনেক আশা ছিল এবারের কপটা ফসিল ফুয়েল ফেজ আউট কপ হবে। যেসব দেশের উন্নতি হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে, ধনী দেশ, তাদের নিয়েই তো সমস্যা। তারাই তো বের হতে পারছে না। তারাই বাগড়া দিচ্ছে। প্রায় দেড়শরও বেশি দেশ ফসিল ফুয়েল থেকে বের হতে রাজি হয়েছে, সম্মতি দিয়েছে; কিন্তু হাতেগোনা ১০টি দেশ বারবার সেখানে বাধা তৈরি করছে। তা হলে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত টার্গেট পূরণ হবে কি করে?
দাবি একটাই আগে ফান্ড গঠন করো, তারপর সঠিকভাবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করো। প্যারিস চুক্তির অধীনে দেশগুলোর হালনাগাদ জাতীয় জলবায়ু কর্ম পরিকল্পনা তুলে ধরো এই সম্মেলনে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে এগিয়ে নেওয়ার বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংকট মোকাবেলায় ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের (ঋণ নয় ক্ষতিপূরণ) প্রতিশ্রুতি বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে থাকতে হবে। সবুজ প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও মালিকানা স্বত্ব থাকতে পারবে না।
লেখক : জলবায়ু পরিবর্তণ বিষয়ে কাজ করা একজন উপকূলীয় বাসিন্দা