কে এস রহমান শফি, টাঙ্গাইল: সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে চলছে ১৫৮টি ইটভাটা। ১২টি উপজেলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসব ইটভাটা। এসব ইটভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরেরও কোনো ছাড়পত্র নেই। অপরদিকে এসব ইটভাটায় কৃষি জমির উপরের উর্বর মাটি ব্যবহার করায় ফসল উৎপাদনেও ব্যাহত হচ্ছে। সব মিলিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। এছাড়াও বৈধ ইটভাটার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে আর্থিক জরিমানা করা হলেও তা স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় ২৮৫টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ১২৭টি ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র আছে। বাকি ১৫৮টি ইটভাটা অবৈধভাবে চলছে। এগুলোর মধ্যে সদর উপজেলায় তিনটি ইটভাটাই বৈধ, দেলদুয়ারে দুটি ইট ভাটার মধ্যে একটি বৈধ, আরেকটি অবৈধ, কালিহাতীতে ১৩টি ইটভাটার মধ্যে তিনটি বৈধ, ১০টি অবৈধ, বাসাইলে নয়টি ইটভাটার মধ্যে দুটি বৈধ, সাতটি অবৈধ, ভূঞাপুরে ছয়টি ইটভাটার মধ্যে একটি বৈধ পাঁচটি অবৈধ, সখিপুরে আটটি ইটভাটার মধ্যে তিনটি বৈধ পাঁচটি অবৈধ, গোপালপুরে ছয়টি ইটভাটার মধ্যে তিনটি বৈধ, তিনটি অবৈধ, মধুপুরে ২০টি ইটভাটার মধ্যে একটি বৈধ, ১৯টিই অবৈধ, নাগরপুরে ২২টি ইটভাটার মধ্যে নয়টি বৈধ, ১৩টি অবৈধ, ধনবাড়ীতে ২০টি ইটভাটার মধ্যে দুটি বৈধ, ১৮টি অবৈধ, মির্জাপুরে ১০৮টি ইটভাটার মধ্যে ৭৬টি বৈধ, ৩২টি অবৈধ, ঘাটাইলে ৬৮টি ইটভাটার মধ্যে ১৯টি বৈধ, ৪৯টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে।
এসব ইটভাটার কয়েকটিতে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে দেদারছে। এছাড়াও ফসলি জমির উর্বর মাটি এবং পাহাড়ের টিলা কেটে ব্যবহার করা হচ্ছে ভাটাগুলোতে। যা একেবারেই অবৈধ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা এলাকায় ফসলি জমি, বসতভিটা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে পরপর তিন ইটভাটা করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এ তিনটি বৈধ হলেও এসব ইটভাটার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবিদরা। ইটভাটার কারণে ফসল উৎপাদান ও গ্রামের মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ওই এলাকার রুবি বেগম নামের এক কৃষাণী বলেন, আমাদের গ্রামে পাশাপাশি তিনটি ইটভাটা রয়েছে। এতে আমাদের ধান উৎপাদন তেমন হয় না। এছাড়াও গাছের নারিকেল ও সুপারিও ঝড়ে পরে।
৭২ বছরের কেসমত আলী বলেন, আমার বাড়ির পাশেই ইটভাটা। যখন ইট পুড়ে অনেক সময় আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। এ সব ইটভাটা বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করি।
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ পৃথিবী’র সাধারণ সম্পাদক সহিদ মাহমুদ বলেন, ‘বন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা করতে হয়। এছাড়াও ঘনবসতি এলাকা থেকে আধা থেকে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা করলে ভাল হয়। সেই হিসেবে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার তিনটি ইটভাটার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’তিনি আরও বলেন, ‘বনের আশে পাশের অবৈধ ইটভাটাগুলোর কারণে পশুপাখির প্রজননের সমস্যা হয়। এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে ইটভাটা থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। অপর দিকে আবাসিক এলাকায় ইটভাটা থাকলে গাছের ফল ও ফুল হয় না। বায়ু দূষণের পাশাপাশি শিশু ও নারীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। তাই অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করা প্রয়োজন।’
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যঅপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আমরা বৈধ ইটভাটার পক্ষে আর অবৈধ ইটভাটার বিপক্ষে। ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও কর্তৃপক্ষ কাঠ পোড়াচ্ছে। এতে বন উজার হচ্ছে। এছাড়াও ফসলি জমির ওপরের উর্বর মাটি ইট ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে। রাষ্ট্র এসব অবৈধ কাজ করতে কোনো ইটভাটা মালিককে অনুমতি দেয়নি।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, ‘চলতি মৌসুমে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কাঠ পোড়া ও পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম না মানার কারণে ৩৭ টি ইটভাটাকে দুই কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও অবৈধ ইটভাটা বন্ধের জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে। সদর উপজেলার যে তিনটি ইটভাটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সেগুলো নবায়ন করা হয়নি। উল্টো তারা উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।’